হোম > ছাপা সংস্করণ

রাজনীতিতে অতি আত্মবিশ্বাসের বিপদ

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

রাজনীতিতে আত্মবিশ্বাস এবং অতি আত্মবিশ্বাসী হওয়ার অভিজ্ঞতা খুব একটা হিসাব-নিকাশে মেলানো যায় না। এ ক্ষেত্রে বেশি সাবধানী হতে হবে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে। কারণ তাদের রাজনীতি ও ভোট অনেকটাই বাস্তব রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল।

ব্যক্তি, দল ও সরকারের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব মোটেও কাম্য নয়। তবে সেই আত্মবিশ্বাস হতে হয় বাস্তব অবস্থার ওপর নির্ভর করে। বাস্তবতাবিবর্জিত আত্মবিশ্বাস কখনো সফল হয় না। সুতরাং আত্মবিশ্বাস নিয়ে ব্যক্তি, দল ও সরকার সব সময় যেন বাস্তবতাবোধে তাড়িত হয়—এটিই কাম্য। কিন্তু আত্মবিশ্বাসের নামে যখন এই তিন ক্ষেত্রে অতি আত্মবিশ্বাস ভর করে, তখন মুখে যতই ভালো কথা বলা হোক না কেন, বাস্তবে এর বিপদ এড়ানো অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব ব্যাপার হওয়া ছাড়া অন্য কিছু আশা করা যায় না। এ বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করছি এ কারণে যে, বাংলাদেশে প্রায়ই রাজনৈতিক দল ও সরকারের মধ্যে অতি আত্মবিশ্বাসী হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কিন্তু অতি আত্মবিশ্বাসী যেকোনো কর্মকাণ্ড শেষ পর্যন্ত বিপদ ডেকে আনতে দেখা যায়। তখন অনেকেরই করার কিছু থাকে না। এই সত্য সংশ্লিষ্টরা জানেন না, তা বলছি না; তবে তাঁরা তা উপলব্ধি করতে প্রায়ই ব্যর্থতার পরিচয় দেন, তেমন অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলো বলার চেষ্টা করা।

সম্প্রতি বিএনপি দেশে সরকারবিরোধী একটি আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। সেটা তারা করতেই পারে। সেই অধিকার তাদের আছেও। কিন্তু আন্দোলন গড়ে ওঠার আগেই বিএনপির নেতাদের মুখ থেকে এমন কিছু কথাবার্তা, হুমকি-ধমকি, ডেডলাইন দেওয়া এবং ক্ষমতার পরিবর্তন হওয়ার গ্যারান্টি দেওয়ার মতো উচ্চারণ শুনে মনে হচ্ছে দলটি এখনই আন্দোলনের ফলাফল সম্পর্কে অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। আত্মবিশ্বাস পর্যন্ত থাকা মোটেও অন্যায় কিছু নয়, কিন্তু অতি আত্মবিশ্বাসের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হয়, সেটি বলা মুশকিল। বিএনপি অতীতেও অতি আত্মবিশ্বাসী হয়েই ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে দেশে যে নৈরাজ্য তৈরি করেছিল, তারপর কী হয়েছিল সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০১৫ সালে টানা ৯৩ দিন অবরোধ ও হরতাল ছেড়ে শেষ পর্যন্ত তাদের ঘরে চলে যেতে হয়। এবার বিএনপি সবে দু-একটি সভা-সমাবেশ শুরু করেছে, এরই মধ্যে নেতাদের কেউ কেউ ১০ ডিসেম্বর ডেডলাইন দিয়ে ফেলেছেন, ওই দিন থেকে বাংলাদেশ নাকি খালেদা জিয়ার নির্দেশে চলবে! তারেক রহমান বিদেশ থেকে দেশে এসে জাতির হাল ধরবেন! আওয়ামী লীগের নেতারা দেশ থেকে পালানোর পথ খুঁজে পাবেন না!—এমন সব দাবি করা হচ্ছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম সে কারণে সরকারকে সেলফ এক্সিট নেওয়ার তাগাদা দিয়েছেন। অন্যান্য নেতাও প্রায় একই ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছেন।

বলা হচ্ছে যে এবার দেশে গণ-অভ্যুত্থান হবে, আবার কেউ কেউ বলছেন গণ-আন্দোলন হবে। দুটো তো চরিত্রগতভাবে আলাদা এবং জনগণের ওপর নির্ভরশীল বিষয়।

বিএনপির নেতাদের মধ্যে যাঁরা টিভি-টক শোতে আলোচক হিসেবে অংশ নিচ্ছেন, তারাও শেখ হাসিনা সরকারের পতন সম্পর্কে যেন নিশ্চিত হয়ে কথা বলছেন। সেই পতন কেউ কেউ এই ডিসেম্বরেই হবে বলেও দাবি করছেন। নেতা-কর্মীদের মধ্যেও এমন একটি অতি আত্মবিশ্বাসী ভাব তৈরি করার চেষ্টা চলছে। এ ধরনের অতি আত্মবিশ্বাসী অবস্থা ২০১৩-১৫ সালেও লক্ষ করা গেছে। এমনকি ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপি জোটের নেতারা ৩১ ডিসেম্বর সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুংকার দিয়েছিলেন। দাবি করা হয়েছিল, ৩০ ডিসেম্বর দেশে ‘নির্বাচনী বিপ্লব’ ঘটে যাবে। সুতরাং নির্বাচনের পরে সরকারি কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকদের দেখে নেওয়া হবে বলেও আ স ম আবদুর রবসহ অনেকেই হুমকি দিয়েছিলেন। এ সবই ছিল তাঁদের অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার মানসিকতা। এবারও সেই সিনড্রোম শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ২০১৩-১৫ এবং ২০১৮-এর অভিজ্ঞতা তাদের একেবারেই আত্মঘাতী ফল ভোগ করতে হয়েছে।

এবার কী হবে, আমরা জ্যোতিষীর মতো কিছু বলতে পারছি না। তবে বিএনপি ও এর জোটভুক্ত দলগুলোর নেতারা, যাঁদের বেশির ভাগই দেশের মানুষের কাছে অপরিচিত, তাঁরাও শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং নিজেদের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ব্যাপারে অতি আত্মবিশ্বাসী ভাব প্রকাশ করছেন, তা গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা লক্ষ করছি।

এখানে দু-একটি বিষয়ে বাস্তবতার অবতারণা করা যেতে পারে। প্রথমত, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এবং সরকারের নির্বাহী ক্ষমতায় তিনি বাসায় অবস্থান করছেন। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। সেটি তিনি বা তাঁকে দিয়ে করানোর চেষ্টা করা হলে সরকার নিশ্চয়ই আইনানুগ পন্থা অনুসরণ করবে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ রোগী বলে দেশবাসী জানে। বিএনপি গত চার-পাঁচ বছর ধরে সেই দাবি করে আসছে; তাঁকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার দাবি তাঁরা করছেন। এখন তাঁরা যদি বলেন যে ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে তিনি দেশ পরিচালনার নেতৃত্ব নেবেন, তাহলে তাঁদের এত দিনকার কথার মধ্যে যে সত্যতা ছিল না, সেটি প্রমাণিত হয়ে যাবে।

তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়টিও আইনগতভাবে বেশ জটিল। সুতরাং এ দুই শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে বিএনপির যেসব কথাবার্তা, তার মধ্যে বাস্তবতার বিস্তর অনুপস্থিতি রয়েছে। ফলে এই আন্দোলনে খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের নেতৃত্বে সবটাই বিএনপি নেতাদের মুখের কথা। বাস্তবে তাতে আস্থা স্থাপন করা মোটেও সহজ নয়।

ফলে মাত্র দুই মাস পরে বাংলাদেশে সরকার উৎখাত এবং খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সফল করার দাবি অতি আত্মবিশ্বাসী হওয়াকেও বোধ হয় ছাড়িয়ে যেতে পারে। তার পরও যদি বিএনপি অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ে, তাহলে দেখার অপেক্ষা করা ছাড়া কারও করার কিছু থাকবে না।

অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বে নামসর্বস্ব অনেকগুলো দল নিয়ে গড়ে ওঠা জোটের পক্ষ থেকে সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন ভেঙে দেওয়া, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়া ইত্যাদি একের পর এক দাবি শুনে আসছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। দলের সাধারণ সম্পাদকসহ আরও কয়েকজন বিএনপি নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্য ও হুংকারের জবাব গণমাধ্যমে দিয়ে আসছেন। আওয়ামী লীগ দৃশ্যত তেমন কোনো জনসভা কিংবা আলোচনা সভায় বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি নিয়ে বিশেষ কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। শেখ হাসিনা দেশে গত ১৩ বছর আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে যে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছেন, তাতে জনগণের বড় অংশ এর মূল্যায়ন করবে। দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, হচ্ছে, বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রবাহ, ডিজিটালাইজেশন, দেশে-বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য, কূটনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে সাফল্য এনেছেন, তার ফলে বেশির ভাগ মানুষ শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন দেবে। দেশে গ্রামীণ সমাজ এবং শহরের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত, এমনকি দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী শেখ হাসিনার শাসনামলে নানাভাবে উপকৃত হয়েছে এবং এর সুফল আওয়ামী লীগ কমবেশি পাবেই—আওয়ামী লীগের মধ্যে এ নিয়ে একধরনের আত্মবিশ্বাস নাকি অতি আত্মবিশ্বাস দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের ধারণা যদি আওয়ামী লীগের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকে, তাহলে এর সুফল তারা কতটা ঘরে তুলে নিতে পারবে, তা সামনের দিনগুলোতে কমবেশি বোঝা যাবে।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে শেখ হাসিনার সরকার দেশে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাঁক পরিবর্তনের সূচনা করেছিল, ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বেশ কিছু সমস্যার সমাধান করেছিল, ১৯৯৮-এর বন্যা সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিল এবং দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রেখেছিল। তখন নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে একধরনের অতি আত্মবিশ্বাস ছিল। হয়তো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বাস্তবতা অনুকূলে যেত, কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অন্য আরেকটি কৃত্রিম বাস্তবতা গভীরে লুক্কায়িত ছিল, যা আওয়ামী লীগ কিংবা অন্য কেউ বুঝতেও পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার মুহূর্ত থেকেই সবকিছু পাল্টে যেতে থাকে। পরবর্তী অবস্থা সবারই জানা বিষয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে মাঠের বাস্তবতা একভাবে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য বাস্তবতা দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। সেটি অনেকে দেখতেও পারেনি, বুঝতেও পারেনি; যা স্পষ্ট হয়েছে নির্বাচনের পর।

সে কারণে আওয়ামী লীগ যেখানে নির্বাচনের আগে বিজয় সম্পর্কে অতি আত্মবিশ্বাসী ছিল, নির্বাচনের পরে তাকে সবচেয়ে বেশি গ্লানিতে পড়তে হয়েছিল। অন্যদিকে বিএনপি বাহ্যিকভাবে কোনো উচ্ছ্বাসও দেখায়নি, কিন্তু ধর্ম ও ভারতবিরোধিতার কার্ড প্রকাশ্যেই খেলেছে; গোপনে শুধু জামায়াতের সঙ্গে ভোট ভাগাভাগির আঁতাতটা সেরে নিয়েছে, তাতেই তাদের কেল্লাফতে। আওয়ামী লীগ এবং আটদলীয় জোটের প্রার্থীরা নিজেদের পরাজয়টা শুধু দেখে দেখেই বরণ করে নিলেন। সে কারণে বলছি, রাজনীতিতে আত্মবিশ্বাস এবং অতি আত্মবিশ্বাসী হওয়ার অভিজ্ঞতা খুব একটা হিসাব-নিকাশে মেলানো যায় না। এ ক্ষেত্রে বেশি সাবধানি হতে হবে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে। কারণ, তাদের রাজনীতি ও ভোট অনেকটাই বাস্তব রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল। বিএনপি এবং অন্যদের বিষয়টি যে আলাদা, সেটি তাদের অতীত ও বর্তমান ধ্যানধারণা থেকেই বুঝে নিতে হচ্ছে। তার পরও রাজনীতিতে কী হবে কী হবে না, তা আগাম বলা যাবে না।

সুতরাং আত্মবিশ্বাস ও অতি আত্মবিশ্বাস সবার জন্য একরকম হয় না; বিশেষত বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনোটাই আগে থেকে অনুমান করা যাবে না।

লেখক: মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ