আজকের প্রবীণেরা যখন তরুণ ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশের ভাবনা ছিল একটা চাকরি জোটানো। চাকরির বাজার ছোট থাকায় অনেকেই আশানুরূপ চাকরি পাননি। উপায়হীন সাহসী তরুণেরা ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিষ্ঠা লাভের চেষ্টা করেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে কেউ সফল, কেউ ব্যর্থ, কেউবা কোনোরকমে টিকে রয়েছেন। এই প্রবীণদের শৈশব-কৈশোর-যৌবনে থাকা-খাওয়া, পোশাকপরিচ্ছদের সংকট ছিল।
শৈশব-কৈশোরে ভাইবোনদের সঙ্গে খাবারদাবার, বইপত্র, বিছানা, কাপড়চোপড় ভাগাভাগি করেছেন। জামা-জুতা ছোট হলে ছোটরা পেত। বড় ক্লাসে উঠলে ছোট ক্লাসে থাকা ভাইবোনেরা বই পেত। নতুন বই কেনা অনেক পরিবারের পক্ষে সম্ভব হতো না। বাড়ির সবাই মিলে ছেলেমেয়েদের জন্য গৃহশিক্ষক রাখতেন।
এগিয়ে থাকা তরুণেরা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তির সুযোগ পেতেন। এই তরুণেরা হলে-মেসে থেকে টিউশনি করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতেন। হলে-মেসে মানসম্মত খাবার পাওয়া কঠিন ছিল। বাড়ি থেকে যাঁর টাকা আগে আসত, তিনি অন্যদের ধার দিতেন। শার্ট, প্যান্ট, জামা, জুতা রুমমেটদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে পরতে হতো। বই, নোট, টিউশনির ব্যবস্থা করে একে অপরকে সহযোগিতা করতেন।
জেলা শহরে তুলনামূলক কম মেধাবী, আর্থিক সংকটে থাকা তরুণেরা যাঁরা স্নাতক পড়তেন, তাঁদের বেশির ভাগের ক্ষেত্রে পাসের হার কম থাকায় অনুত্তীর্ণদের মধ্য থেকে কেরানি, স্কুলশিক্ষক, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগ দিতে পারতেন। স্নাতক উত্তীর্ণরা তুলনামূলক ভালো চাকরি পেতেন।
৫০ বছর আগের তরুণদের বড় একটি অংশ বাতিল সংস্কৃতির ধারক-বাহক হয়ে ওঠেন। তাঁরা পুরোনো চিন্তাচেতনা, রুচি, সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন আনতে চাইলেন। সমাজ পরিবর্তনের নতুন নতুন চিন্তাভাবনা সামনে নিয়ে এলেন। আরেক দল তরুণ সমাজের চলমান চিন্তাচেতনা, রুচি, সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন করতে চেয়েছেন; অর্থাৎ একদল বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার সংস্কার করে চলমান রাখতে চেয়েছে, আরেক দল সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে লড়াই জারি রেখেছে।
শেষ পর্যন্ত ৫০ বছর আগের তরুণেরা প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করে তাঁদের সময়কালকে স্বর্ণ যুগ হিসেবে অভিহিত করেছেন। জীবনযুদ্ধে তাঁদের লড়াই-সংগ্রামকে মহিমান্বিত করার জোর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁদের যাপিত শৈশব-কৈশোর-যৌবন কতটা রঙিন, আনন্দের, লড়াই-সংগ্রামের ছিল, তা তুলে ধরেন।
সমাজে মেনে চলার, মানিয়ে নেওয়ার সংস্কৃতি জোরদার হতে শুরু করেছে। সংসারে, সমাজে, রাষ্ট্রে ছাড় পাওয়ার এবং ছাড় দেওয়ার মানসিকতা গড়ে উঠছে। সম্পর্কের টানাপোড়েনকে মেডিটেশন, ইয়োগা, ধ্যানের মাধ্যমে ব্যক্তির কষ্ট উপশমের নানান প্রচেষ্টা জনপ্রিয় হচ্ছে।
যোগাযোগমাধ্যম টেলিফোনে বিড়ম্বনার শিকার হওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। লাইনম্যান, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, টেলিফোন বিল, ক্রস কানেকশন, টেলিফোনে চাঁদাবাজি, হুমকি অনেকে ভুলে যাননি। সেই সব সংকট নিরসনে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়নি। সংকট নিরসন হয়েছে মোবাইল কোম্পানির আগমনে, অর্থাৎ পুরোনো ব্যবস্থা বহাল রেখে সংকট নিরসন করা যায় না।
ডাক বিভাগের চিঠিপত্র বিলি-বণ্টন, টাকাপয়সার লেনদেন নিয়ে বিস্তর অভিযোগ ছিল। সংকট নিরসন হয়েছে ই-মেইল, কুরিয়ার সার্ভিস, ইএফটিসহ উন্নত পদ্ধতি গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে।
রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য অনেক লড়াই-সংগ্রাম, বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। শাসকশ্রেণি চাহিদা অনুযায়ী দাবি পূরণ করেনি।
এখন বেসরকারি টেলিভিশন, ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক, টুইটার, প্রিন্ট মিডিয়ায় ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রকাশিত হয়ে যায়। বলতে গেলে কোনো ঘটনা আর গোপন থাকছে না।
আমাদের নতুন প্রজন্ম বাতিল সংস্কৃতির প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে বলে আমার ধারণা। নতুন প্রজন্ম যেসব বিষয়ে অস্বস্তি বোধ করে, কষ্ট পায় সেসব বাতিল করে দিচ্ছে। কোনো কিছু ভালো না লাগলে তা মুখের ওপর সরাসরি বলতে পারে।
মোবাইল-ইন্টারনেটের আসক্তি নিয়ে অনেক সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু করোনার সময় উল্টো শিশু-কিশোরদের হাতে তো মোবাইল, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট দিয়ে শিক্ষাজীবন সচল রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণের নতুন পরিস্থিতি বর্তমান। তরুণদের বড় অংশ নিয়ম করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে উপস্থিত হয়ে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী নন। ক্লাসে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক না হলে উপস্থিতি হতাশাজনক হয়ে পড়ত। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে চাকরির বাজারে প্রবেশ প্রচণ্ড প্রতিযোগিতামূলক হয়ে পড়েছে।
তরুণদের যে অংশ কৃষক-শ্রমিক হিসেবে কাজ করে, তারা সংসারের জাঁতাকলে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। বিদেশে কর্মরত তরুণ শ্রমিকেরা কঠিন পরিশ্রম করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছেন কিন্তু সম্মান প্রাপ্তির ঘাটতি আছে। আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে রয়েছে। তাঁরা নানান ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন।
আজকের প্রবীণেরা যখন নবীন ছিলেন তখন তাঁদের যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে, তার চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ বর্তমান প্রজন্মকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
পৃথিবী দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবন নবীনেরা দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলেছে। অতীতের সাফল্য, ব্যর্থতা, অর্জন, অভিজ্ঞতা, ইতিহাস মোবাইল ফোনে এক মুহূর্তে জানার সুযোগ রয়েছে। ফলে প্রবীণের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, বুদ্ধি, বিবেচনা, বুঝতে পারা খুব জরুরি কোনো বিষয় নয়। প্রবীণদের একটি অংশ নবীনদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। তাঁরা মনে করেন, তরুণ প্রজন্ম ঠিক পথে নেই। প্রবীণদের মধ্যে অনেকেই ভাবতে পারছেন না যে নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে পৃথিবীর বর্তমান চেহারা পাল্টে দিতে পারে। মানুষের বাসযোগ্য সুন্দর পৃথিবী নতুন প্রজন্ম আমাদের উপহার দিতে পারে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার পৃথিবীর বর্তমান সংকটকে গৌণ করে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র-সমাজ গড়ে উঠতে পারে। একটি কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রে বা সমাজে প্রবীণেরা সবার সঙ্গে সম্মান-মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবেন। তাঁরা বুঝতে পারবেন নতুন প্রজন্ম পুরোনো চিন্তা-ভাবনার জীবনযাপন বাতিল করে স্বস্তিদায়ক মর্যাদাপূর্ণ মানবজীবন উপহার দিয়েছে।
নতুন প্রজন্ম সব অনিয়ম, দুর্নীতি, নিপীড়ন, নির্যাতনকে বাতিল করে দেবে। তারা আপস সংস্কৃতিকে না করে বাতিল সংস্কৃতির দিকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে আসছে। আজ যেটাকে আমরা বিশৃঙ্খলা বলে মনে করছি, একদিন সেটাই হবে কাঙ্ক্ষিত শৃঙ্খলার পূর্বশর্ত।