আমি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ। ৫২ বছরের প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানে শিশু শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। করোনার আগে স্বাভাবিক সময়ে এখানে ক্লাস শুরুর পূর্বে প্রাত্যহিক সমাবেশ হতো। এতে সব শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে সামনে পেয়ে মনটা ভরে যেত। করোনা পরিস্থিতিতে এই সুখটুকু মিস করেছি। এখন প্রতিষ্ঠান খুলেছে। পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হলে আবারও হয়তো প্রাত্যহিক সমাবেশের মধ্য দিয়ে দিনটি শুরু হবে।
তবে সমাবেশের একটি বিষয় আমার মোটেই ভালো লাগে না। সেটি হলো এই নিষ্পাপ বাচ্চাদের দিয়ে শপথবাক্য পাঠ করানো। আমরা শিশুকালে যে শপথবাক্য পাঠ করেছিলাম তার সঙ্গে নতুন লাইন যুক্ত করা হয়েছে-‘কোনো দুর্নীতি করিব না, কোনো প্রকার দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিব না’। এই কাজকে আমি ভণ্ডামি মনে করি। বছরের পর বছর আমরা এই ভণ্ডামি করে যাচ্ছি, আগামীতেও করব।
কৌতূহলবশত আমি বিভিন্ন শ্রেণির কিছু শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ চালিয়েছিলাম। এই শপথ বাক্যটি তারা বোঝে কি না, তারা এটিকে বিশ্বাস করে কি না বা ব্যক্তি জীবনে তারা এটা পালন করবে কি না এ নিয়ে আমি আলাদাভাবে তাদের কাছে জানতে চেয়েছি। তৃতীয় শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেছে, তারা দুর্নীতি কাকে বলে জানে না। তোমরা তাহলে কেন বলছ কোনো দুর্নীতি করব না? তাদের জবাব, ‘স্যার বলতে বলে তাই বলি।’ পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলে, ‘স্যার দুর্নীতি মানে মানুষের জিনিস চুরি করা।’ বললাম তুমি কি চুরি কর? জবাব, ‘জি না স্যার।’ বড় হলে চুরি করবে? ‘জি না স্যার।’ তাহলে শপথ করছ কেন? জবাব, ‘স্যার যে শপথ করতে বলে।’ একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, ‘স্যার আমি দুর্নীতি করি না। কিন্তু ভবিষ্যতে করব কি না তা তো বলতে পারি না। এখন শপথ করলে সেটা কি মনে থাকবে স্যার?’
একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীটি আমার মাথা ঘুরিয়ে দিল। তাই তো, আমরা বড়রা নানা প্রকার দুর্নীতি, অনিয়ম, দায়িত্বহীনতা ও দেশের জন্য ক্ষতিকর কাজের সঙ্গে জড়িত। প্রতিদিন অফিস শুরুর আগে এই শপথবাক্য তো আমাদেরই পাঠ করানো উচিত। শিশুদের কেন আমরা এই দুর্বোধ্য শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছি। স্কুলজীবনে তো আমরা প্রতিদিনই এই শপথবাক্য পাঠ করেছি। আমরা কি সেই শপথ রক্ষা করে চলছি? আমাদের ব্যক্তি জীবন থেকে আমরা জানলাম, স্কুলজীবনের শপথবাক্য কর্মজীবনে মনে থাকে না।
আর একটি বিষয় লক্ষণীয়, কিছু মানুষের সাংসারিক ব্যয় এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তাঁদের আয়ের থেকে অনেক বেশি। এসব পরিবারের যে শিশু তার বাবা-মায়ের দুর্নীতি-অনিয়ম থেকে অর্জিত সম্পদ ভোগ করে অভ্যস্ত তাকে নীতিবাক্য বা শপথবাক্য শিখিয়ে লাভ কী? এই ধরনের শিশুদের নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার মতো শিক্ষক পৃথিবীতে কতজন আছেন?
আমরা জানি, পরিবার সন্তানের প্রথম শিক্ষালয় এবং বাবা-মা প্রথম শিক্ষক। পারিবারিক শিক্ষাকে কখনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অতিক্রম করতে পারে না। তাই, আমার প্রস্তাব হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শপথবাক্য পাঠ না করিয়ে প্রতিদিন অফিস শুরুর আগে প্রতিটি অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এই শপথবাক্য পাঠ করানো হোক। সব অফিস বড়কর্তার নেতৃত্বে শপথবাক্য পাঠের মাধ্যমে দিনের কার্যক্রম শুরু করবে। আবার ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের জন্য নিজ কর্মস্থলে প্রাত্যহিক শপথের ব্যবস্থা করতে হবে। আমার মনে হয় এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।
লেখক: অধ্যক্ষ, লালকুঠি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়, রংপুর।