হোম > ছাপা সংস্করণ

ইলিশের বেড়ে চলা দামের ব্যাখ্যা প্রয়োজন

হাসান মামুন

দেশে ইলিশের উৎপাদন ও আহরণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন এর দাম অধিক হারে বেড়ে চলেছে, সেটা প্রশ্ন বটে। ইলিশ কিনতে না পারা বিপুলসংখ্যক মানুষ এটা জিজ্ঞেস করছে ক্ষোভের সঙ্গে। তাতে তো আর দাম কমবে না! এই পরিস্থিতিতে ভারতে প্রায় চার হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। তবে জানা যাচ্ছে, এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ ইলিশও পাঠাতে পারেননি রপ্তানিকারকেরা।

এর বড় কারণ, গেলবারের চেয়ে অনেক বেশি দামে ইলিশ সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাঁদের। যাঁরা আমদানি করছেন, তাঁরাও ইলিশের দামে অসন্তুষ্ট। এরই মধ্যে ১২ অক্টোবর থেকে শুরু হতে যাচ্ছে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা। যে সময়ের মধ্যে এটা রপ্তানি করতে বলা হয়েছে, তার অনেকটা পড়ে যাচ্ছে নিষেধাজ্ঞায়। প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা, বিক্রি, পরিবহন বন্ধ থাকলে রপ্তানিও বন্ধ থাকার কথা। এর মধ্যে পূজাও পেরিয়ে যাবে। পরে আর রপ্তানির সুযোগ না দেওয়ারই কথা। সুতরাং গতবারের মতো এবারও বেশি ইলিশ পাঠানো যাবে না ভারতে।

চলতে থাকা প্রতিকূল আবহাওয়ায় ইলিশ আহরণও গেছে কমে। বিক্রেতারা বলছেন, এবার এক-চতুর্থাংশ ইলিশ কম পেয়েছেন তাঁরা। এ অবস্থায় ইলিশের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়বে কেন, এর ভালো ব্যাখ্যা নেই। এক কেজি সাইজের মানসম্পন্ন ইলিশ ১ হাজার ৫০০ টাকার নিচে মিলছে না। গত বছর এটা হাজার টাকায় পাওয়া গিয়েছিল। সেই দামেও ক্রেতারা অসন্তুষ্ট ছিলেন। এবার তাঁরা ক্ষুব্ধ। এরই মধ্যে ইলিশ রপ্তানির খবর পেয়ে অনেকের ক্ষোভ আরও বেড়েছে। দেশের মানুষকে যতটা সম্ভব কম দামে ইলিশ খাওয়াতে এর রপ্তানি কিন্তু বন্ধ রাখা হয়েছে সাধারণভাবে। আর প্রতিবছর যে পরিমাণ ইলিশ আহরণের কথা বলা হচ্ছে, সেই তুলনায় ভারতে রপ্তানি তো খুবই কম। অনুমতিটা আবার দেওয়া হয়েছে ভরা মৌসুমে। আর দেখাই যাচ্ছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী রপ্তানি করা যাচ্ছে না।

নিষেধাজ্ঞায় পড়ে না গেলেও খুব বেশি ইলিশ বোধ হয় পাঠাতে পারতেন না রপ্তানিকারকেরা। তার কারণ আগেই বলেছি—ইলিশ মিলছে কম এবং দামটা অনেক বেশি। একবারে অনেক কিনলে অবশ্য পাইকারি দরে পাওয়া যায়। তারপরও মুনাফাসহ অন্যান্য খরচ যোগ করলে রপ্তানিতেও দাম কম পড়ছে না। ভারত, বিশেষ করে কলকাতা থেকে পাওয়া খবরে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ইলিশের দাম সেখানেও বেশি; অনেকটা এখানকার মতোই। সেখানেও ইলিশ কিনতে না পারা বাঙালির মনোবেদনার অন্ত নেই। তাদেরও অপেক্ষাকৃত কম দামে কম স্বাদের ইলিশ খেতে হচ্ছে। বাংলাদেশ, ভারত বা মিয়ানমার অংশের সাগরে ধরা ইলিশ একটু কম দামে মেলে সবখানেই। এর একাংশ কেটে লবণ মাখিয়ে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। ডিমটা বিক্রি হয় আলাদা করে। ইলিশের ডিমের দামও অনেক বেড়েছে। এর চাহিদা বেড়েছে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে ও রেস্তোরাঁয়। অনলাইনে ইলিশের পাশাপাশি এর ডিম বিক্রি হচ্ছে। এসব বিক্রেতাও একযোগে ইলিশ কিনে সংকট সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে স্থানীয়দের। কারণ স্থানীয় ক্রেতারা ওই সব পাইকারি ক্রেতার চাপে ইলিশ কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। সেখানে দাম তাই অনেক ক্ষেত্রে শহর-বন্দরের চেয়েও বেশি।

জেলে থেকে শুরু করে খুচরা ক্রেতা পর্যন্ত ইলিশ কেনা-বেচার একটা চেইন তো আছে। এটাকে অনেকে ‘সিন্ডিকেট’ বলে থাকেন। তবে এটা কর্কশ বাস্তবতা। যাঁরা আগাম পয়সাকড়ি দিয়ে রাখেন ইলিশ আহরণ করে তাঁদের কাছে বিক্রি করতে, সরবরাহটা স্বভাবতই তাঁরা পান। দেশে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় ইলিশ দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে গন্তব্যে। আর সবখানেই রয়েছে এর বিরাট চাহিদা। সব শ্রেণির মানুষই তো ইলিশ খেতে চান। সেটা অবশ্য ‘কার্যকর চাহিদা’ নয়। কার্যকর চাহিদা তৈরি করছেন তাঁরা, যাঁদের ক্রমবর্ধমান দামেও ইলিশ কেনার সামর্থ্য আছে। এ ধরনের ক্রেতা ১৭-১৮ কোটি মানুষের দেশে একেবারে কম নয়। তাঁরা একবারে অনেক ইলিশ কিনে ফ্রিজে সংরক্ষণ করে দীর্ঘদিন খেতে চান। অতিথিকে ইলিশ খাওয়ানোর সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছে। বেড়েছে উপহার হিসেবে কোয়ালিটি ইলিশ পাঠানো। ইলিশের রেসিপিও বেড়েছে। কীভাবে যেন ইলিশের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বাঙালির বর্ষবরণ—যদিও ওই সময়টা ঠিক ইলিশের মৌসুম নয়। অনেকে তখন আগের মৌসুমে ধরা হিমায়িত ইলিশ সংগ্রহ করেন উচ্চ দামে। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই তা আর মানসম্মত থাকে না। তবু ইলিশ বলে কথা!

এ ব্যাপারটাই নাকি ইলিশের দাম অব্যাহতভাবে বাড়ার মূল কারণ। সম্প্রতি আবার জানা যাচ্ছে, গৃহীত নানা পদক্ষেপে দেশের জলসীমায় ইলিশ আহরণ বাড়লেও এর প্রবৃদ্ধি কমতির দিকে। এর মধ্যে ইলিশ রপ্তানির খবর প্রচার হলে বাজারে এর প্রভাব পড়ে বৈকি। অর্থনীতির নিয়মেই সেটা পড়ে।

অতিমুনাফাপ্রবণ ব্যবসায়ীদের জন্য তা বিশেষ সুযোগও সৃষ্টি করে। তাঁদের তো রয়েছে বিপুল পরিমাণ ইলিশ কিনে মাসের পর মাস ধরে রাখার ক্ষমতা। এবার আলুর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার পর সরকারি নজরদারি সংস্থার লোকেরা কিছু হিমাগারে গিয়েছিলেন এর সংরক্ষণ ও বিক্রয় পরিস্থিতি দেখতে। সাপ্লাই চেইনের বিভিন্ন পয়েন্টে ইলিশ ধরে রেখে অস্বাভাবিক দামে বিক্রি হচ্ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা যেতে পারে, নাকি? ইলিশের দামের বিষয়ে এমনকি মধ্যবিত্তের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নিয়ে এমন কার্যক্রম চালিয়ে দেখা যেতে পারে।

নজিরবিহীন ডেঙ্গু পরিস্থিতির মধ্যে ডাবের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে ভোক্তা অধিদপ্তর এ ব্যবসায় জড়িতদের সঙ্গে বসে তাদেরও একটা কাঠামোয় আনার কথা বলেছিল। ‘জাতীয় মাছ ইলিশ’ নিয়ে বছরের পর বছর যা চলছে, তাতে এর উচ্চ দামের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বাংলাদেশের সমুদ্র, মোহনা ও নদীগুলোয় বিশ্বের মোট ইলিশের ৮০-৮৫ শতাংশই নাকি পাওয়া যাচ্ছে। হচ্ছে এর ব্র্যান্ডিংও। কিন্তু দেশের সিংহভাগ মানুষ এমনকি ভরা মৌসুমেও ইলিশ খেতে পারছে না। এটা ক্রমেই হয়ে উঠছে তাঁদের স্মৃতি রোমন্থনের বিষয়। অগত্যা ইলিশ কেটে ভাগ করে বিক্রির দাবি এখন জোরদার। মেগাশপে পিস করে প্যাকেটে ইলিশ বিক্রি শুরু হয়েছে। ভরা মৌসুমে ছোট ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা না থাকায় এসব কিনেও অনেকে আক্ষেপ মেটাচ্ছেন। ডিমওয়ালা, নিম্নমানের ইলিশের চাহিদা আছে স্বল্পআয়ের ক্রেতার মধ্যে। এই শ্রেণির ক্রেতারা অসহায়ভাবে দেখছেন উচ্চবিত্তের ‘ইলিশ উৎসব’। জীবনযাত্রার বৈষম্য প্রকটভাবে ধরা পড়ছে এর মধ্যেও।

অথচ আগে ভরা মৌসুমে গরিবেরাও কমবেশি ইলিশ কিনতে পারত। এক ফেসবুক বন্ধু তাঁর পোস্টে একসময়কার জনপ্রিয় ফিলিপস বাল্বের বিজ্ঞাপন স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সম্প্রতি। তিনি বলছেন, সমাজের যে স্তরে ওই বাতি জ্বালিয়ে পাটিতে বসে ইলিশ খাওয়ার দৃশ্য বিজ্ঞাপনটিতে দেখানো হয়েছিল—তাঁরা এখন আর ইলিশ কিনতে পারছেন না। বাজারে গিয়ে চারটি বড় ইলিশ কিনে ব্যাগে ভরার সময় তিনি ছোট ইলিশ কিনতে আসা একজন বয়স্ক গৃহিণীর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলেন না একধরনের অপরাধবোধে কাবু হয়ে। এ অবস্থায় মিডিয়ার রিপোর্টাররা বলছেন, আগে ইলিশ মৌসুমে অন্যান্য মাছের দামে এর যে প্রভাব পড়ত, সেটাও ঘটছে না ইলিশ আর সুলভ নয় বলে। বলা যায়, এর একটা বিশেষ ক্রেতাগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে! তাই হয়তো গত ছয় মাসে সামগ্রিকভাবে মাছের দাম ২০ শতাংশ বেড়েছে। অথচ এ সময়ের অনেকটাই ছিল ইলিশ আহরণ ও বিক্রির তুঙ্গ সময়।

এখন তো ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার পর্বও এসে গেল। ঠিক সময়ে এটা পালিত হচ্ছে কি না, নিজ দেশের জেলেদের কোনোমতে বিরত রাখা গেলেও আশপাশের জেলেরা এসে আমাদের জলসীমা থেকে ইলিশ ধরে নিয়ে যাবে কি না এবং ওই সব দেশে একই সময়ে নিষেধাজ্ঞা পালিত না হলে এখানে ইলিশ রক্ষা আদৌ কতটা হবে—এসব প্রশ্নও রয়েছে। দেশে ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম মোটের ওপর জোরদার নয়, এটা অবশ্য বলা যাবে না। এতে করে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। তা সত্ত্বেও ইলিশের দাম অধিক হারে বাড়ছে কি শুধু এর আহরণ ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে ওঠার কারণে? তাতেও কিন্তু হিসাব মেলে না। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো ইলিশের উৎপাদন, আহরণ ও চাহিদার হিসাবে বড় গোলমাল নেই তো? রপ্তানি বন্ধ থাকা অবস্থায় বিরাট চাহিদা রয়েছে বলে কিছু ইলিশ কি চোরাচালানও হচ্ছে না? বিশেষ করে এবার ইলিশের দাম যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে, সেটা মাছের বাজারে চলমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গেও বড় বেমানান। ইলিশ আহরণ কোনো কারণে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার মধ্যে এর কারণ নিহিত থাকলে সেটা কিন্তু স্বীকার করা উচিত। সমস্যার অস্বীকৃতিতে কোনো সুফল মিলবে না।

লেখক: হাসান মামুন,সাংবাদিক, বিশ্লেষক

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ