সাবেক মন্ত্রী, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ৮১ বছর বয়সে ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ইন্তেকাল করেছেন।
আলোচিত-সমালোচিত এই প্রবীণ রাজনীতিকের মৃত্যুতে মনটা স্বভাবতই বিষণ্ন হয়েছে। যদিও তিনি পরিণত বয়সেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। তাঁর নিকটজনেরা তাঁকে রিন্টু নামে ডাকতেন। আমরা বলতাম, হুদা ভাই। রাজনীতিতে হুদা ভাইয়ের আগমন ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত জাগদলের মাধ্যমে। তারপর ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করলে নাজমুল হুদা সেই দলে সম্পৃক্ত হন এবং এর প্রথম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হন। তার পর থেকে বিএনপির সঙ্গে ছিল তাঁর দীর্ঘদিনের পথচলা। তবে স্থায়ী কমিটি অনেকবার পুনর্গঠিত হলেও নাজমুল হুদার স্থান সেখানে হয়নি। দলত্যাগের আগে তিনি ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
বিএনপির একজন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান এবং কর্মিবান্ধব নেতা ছিলেন নাজমুল হুদা। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেবার তিনি খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। কিন্তু পুরো মেয়াদ সে পদে থাকতে পারেননি। ১৯৯৬ সালে বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের সময় নাজমুল হুদা একটি আপস ফর্মুলা দিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরাগভাজন হয়ে মন্ত্রিত্ব হারান। তিনি ফর্মুলা দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের সিনিয়র একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের। তাঁর সেই প্রস্তাব সুধী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও দলের শীর্ষ নেতৃত্বের রোষানলে পড়েন তিনি। অবশ্য শেষ পর্যন্ত যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল বিএনপি সংসদে পাস করে, তা নাজমুল হুদার প্রস্তাবেরই প্রতিকৃতি বলা যায়। মন্ত্রিত্ব হারালেও দলে তিনি বহাল থেকে যান। মোট চারবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন নাজমুল হুদা। সর্বশেষ ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় যোগাযোগমন্ত্রী হন। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি দুর্নীতির মামলা হয়; যার একটিতে সাজাপ্রাপ্ত হন তিনি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন একজন নেতা হলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপিতে তিনি থাকতে পারেননি। দলের মধ্যে একটি চক্র তাঁকে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করেছে সব সময়। তাঁদেরই চক্রান্তে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়। তবে নিজ এলাকায় বিপুল জনপ্রিয় ছিলেন নাজমুল হুদা। এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে তিনি মানুষের মন জয় করেছিলেন।
দলের একজন জুনিয়র কর্মী হলেও নাজমুল হুদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল বেশ ঘনিষ্ঠ। তিনি যখন যোগাযোগমন্ত্রী, আমি সে সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব। এলাকার রাস্তাঘাটের সমস্যা সমাধানের জন্য আমি মাঝেমধ্যেই তাঁর দ্বারস্থ হতাম। এলাকার কয়েকজন উৎসাহী তরুণ আমাকে বলল, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে বিআরটিসির বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নিতে। বিষয়টি নিয়ে হুদা ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বললেন, এলাকাবাসীর একটি দরখাস্ত নিয়ে যেতে। তিনি তাতে সুপারিশ করে দিলেন। সে সময় বিআরটিসির চেয়ারম্যান ছিলেন তৈমূর আলম খন্দকার। ২০০২ সালে ঢাকা-মাওয়া বিআরটিসি বাস সার্ভিস চালু হয়। হুদা ভাই নিজেই তা উদ্বোধন করেছিলেন। আমাদের থানা সদর শ্রীনগরের ওপর দিয়ে যেতে হয় উপজেলার ভাগ্যকুল-বাঘড়া এবং হুদা ভাইয়ের এলাকা দোহারে। শ্রীনগর বাজারসংলগ্ন সরু সড়কটিতে যানবাহনের জট লেগেই থাকত। একদিন সমস্যাটির দিকে হুদা ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। বললাম, শ্রীনগর বাজারকে ডানে রেখে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক থেকে একটি বাইপাস সড়ক নির্মাণ করা হলে এ সমস্যা থাকবে না। সে সময় সড়ক ও জনপথ বিভাগ মুন্সিগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন মৃধা নজরুল ইসলাম। হুদা ভাই তাঁর দপ্তর থেকেই মৃধাকে ফোন করলেন। প্রকল্প তৈরি হলো ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের মাশুরগাঁও পয়েন্ট থেকে শ্রীনগর-দোহার সড়কের জুশুরগাঁও পয়েন্ট পর্যন্ত। মোটামুটি এক কিলোমিটার পথ। প্রকল্প যখন চূড়ান্ত, তাতে বাগড়া দিলেন বিএনপির একটি সহযোগী সংগঠনের এক কেন্দ্রীয় নেতা। তিনি প্রস্তাব দিলেন নির্ধারিত স্পট থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পশ্চিমে সরে সমষপুর পয়েন্ট থেকে ওই নেতার বাড়ি দামলা গ্রাম বরাবর বাইপাস সড়কটি নির্মাণের। নির্বাহী প্রকৌশলী মৃধা নজরুল ইসলাম আমাকে তা জানালে আমি হুদা ভাইয়ের অফিসে গেলাম। তাঁকে বললাম, ‘যে পয়েন্টে বাইপাস নির্মাণের কথা রয়েছে, তার বদলে নতুন প্রস্তাবের জায়গায় করা হলে অন্তত তিন গুণ দূরত্ব বাড়বে এবং খরচও বাড়বে। এটা করা হলে প্রশ্ন উঠবে, কম খরচে স্বল্প দূরত্বে বাইপাস নির্মাণ না করে অতিরিক্ত খরচ করে মন্ত্রী কেন বেশি দৈর্ঘ্যের বাইপাস সড়ক বানালেন? এতে রাষ্ট্রীয় তহবিল অপচয়ের অভিযোগ উঠতে পারে আপনার বিরুদ্ধে।’ উল্লেখ্য, সে সময় কোনো একটি ঘটনার কারণে নাজমুল হুদার সঙ্গে মিডিয়ার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। হুদা ভাই ‘আচ্ছা দেখি’ বলে আমাকে বিদায় দিলেন। এর কয়েক দিন পরেই এক শুক্রবার আমাকে নিয়ে পূর্বনির্ধারিত স্থানে মাটি কেটে বাইপাস সড়কের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করলেন তিনি।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা নাজমুল হুদা কেন বিএনপি ছাড়তে বাধ্য হলেন, তা অনেকেরই বোধগম্য নয়। আমরা যাঁরা তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলাম, তাঁরা তাঁকে বলতাম, আপনি স্পষ্টবাদিতা কমিয়ে দিন। কিন্তু তিনি তা অনেক সময়ই মানতেন না। একবার দুই নেত্রীর ঈদকার্ড বিনিময়কে তিনি ‘হিপোক্রেসি’ বলে আখ্যায়িত করে বিপাকে পড়েন। তাঁর বক্তব্য ছিল, যেখানে দুই নেত্রী একে অপরের ছায়া মাড়ান না, সেখানে এসব কার্ড বিনিময় অর্থহীন, লোকদেখানো। দলের মধ্যে তাঁর শত্রুরা এটাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করল; নাজমুল হুদা খালেদা জিয়াকে ‘হিপোক্রেট’, অর্থাৎ ভণ্ড বলেছেন। তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন। এরপর সম্ভবত ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট বার কাউন্সিল নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া তাঁকে গুলশান অফিসে ডেকে নিয়ে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নির্বাচনে দলীয় প্যানেলের পক্ষে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। টেলিভিশনে খবরটি দেখে পরদিন সকালে ফোন করলাম হুদা ভাইকে। বললাম, ‘অভিনন্দন হুদা ভাই।
বহিষ্কারাদেশ তো প্রত্যাহার হলো, কিন্তু আপনার পদ-পদবি ফিরে পাওয়ার চিঠি দিয়েছে তো?’ তিনি বললেন, ‘ম্যাডাম বলে দিয়েছেন, ওরা পরে পাঠিয়ে দেবে।’ আমি তাঁকে বললাম, ‘ভাই, আপনি ভুল করেছেন। চিঠি হাতে হাতে নিয়ে আসা উচিত ছিল। আমার আশঙ্কা, ওই চিঠি আপনি আর কখনোই পাবেন না। কারণ, নামের পেছনে “বিশ্বাস” পদবি থাকলেই সবাইকে বিশ্বাস করা যায় না।’ বলা নিষ্প্রয়োজন, হুদা ভাই সে চিঠি আর পাননি। পরে ২০১২ সালে বিএনএফ করলেন। আরও পরে বিএনএ এবং সর্বশেষ তৃণমূল বিএনপি।
বিএনপির একটি ট্র্যাজিক দিক হলো, এই দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতাদের অনেককেই শেষ জীবনে অপমান-অপদস্থ হয়ে দল ছাড়তে হয়েছে। জীবনের মূল্যবান সময় দলের জন্য ব্যয় করেও একটা সময়ে এসে দল কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছেন। নাজমুল হুদাও তাঁদের একজন। আজ তাঁর মৃত্যুর পরে কেউ কেউ তাঁকে সমালোচনার তিরে বিদ্ধ করতে চাইছেন। কিন্তু নাজমুল হুদা কেন বিএনপি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, তা তলিয়ে দেখছেন না।
যে ধরনের আচরণ দল তাঁর সঙ্গে করেছে, আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন কারও পক্ষেই তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। নাজমুল হুদাও
তা পারেননি।
দোষে-গুণে মানুষ। নাজমুল হুদাও রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন। তাঁরও হয়তো দোষ ছিল, ভুল ছিল। দুঃখজনক হলো, তাঁর চেয়ে আরও গর্হিত অপরাধ করেও অনেকে দলের ক্ষমা পেয়ে গেছেন, কিন্তু তিনি পাননি। এটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
মহিউদ্দিন খান মোহন, সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক