দখলে উপনিবেশ থাকলে অনেক সুবিধা। ধনসম্পত্তি আসে, বৈষয়িক উন্নতি ঘটে। সুবিধা সাহিত্যের জন্যও। যেমনটা ধরা যাক, চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসের ক্ষেত্রে ঘটেছে। চরিত্র নিয়ে কী করা যায়, ঠিক করা মুশকিল দেখলে ডিকেন্স অনেক সময় তাদের পাঠিয়ে দিতেন উপনিবেশে। তাঁর গ্রেট এক্সপেকটেশনস উপন্যাসের ম্যাগউইচ গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়, সেখানে গিয়ে টাকাপয়সা করে ফিরে এল লন্ডনে। ডিকেন্সের এই সুবিধাটা ছিল। কিন্তু তাঁর পঞ্চাশ বছর আগে ওই যে শান্ত নারী ঔপন্যাসিক জেন অস্টিন, তিন-চারটি পরিবার নিয়ে যিনি লিখতেন, যাঁর সময়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে ভয়ংকর যুদ্ধ চলছিল অথচ তার খবর তিনি উপন্যাসে দেননি, সেই জেন অস্টিনের ছয়টি উপন্যাসের একটিতে উপনিবেশ যে খুব বাস্তবিকভাবে রয়েছে, সেটা অনেকেরই খেয়াল থাকার কথা নয়। অথচ সত্য এই যে ওই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় পরিবারের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও নৈতিক সমস্যা দুটোই এন্টিগুয়ায় তাঁদের পারিবারিক সম্পত্তির সঙ্গে যুক্ত। সম্পত্তি না থাকলে উপন্যাসটি থাকে না, কেননা পরিবারের ধনসম্পত্তি থাকে না।
এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদের বই কালচার অ্যান্ড ইম্পিরিয়ালিজম উপনিবেশের সাংস্কৃতিক মূল্যের দিকটা খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে। সাঈদ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন, সাংস্কৃতিকভাবে তাঁর দুটো পরিচয়—একদিকে প্যালেস্টিনিয়ান, অন্যদিকে আমেরিকান। সাম্রাজ্যবাদের দুই দিকই দেখেছেন তিনি। দেখতে পেয়েছেন। তাঁর জানা ছিল দখলকারীকে, জানা ছিল তাঁর দখলকৃত্যকেও। সভ্যতার ইতিহাস যে একই সঙ্গে বর্বরতারও ইতিহাস, এ তিনি সাহিত্যপাঠ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা—উভয় সূত্র থেকেই জেনেছিলেন এবং মূলত সাহিত্যকে ব্যবহার করে সভ্যতার অন্তরালে বর্বরতা কীভাবে কাজ করছে, সেই সত্যটাকে দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন।
সাঈদের সাহিত্য সমালোচনারও একটা নিজস্ব গুরুত্ব রয়েছে। সাহিত্য সমালোচনার মূলধারা এখন একটি স্তব্ধ জলাশয়। সেখানে প্রবাহ নেই। শব্দ গোনা, বাক্য ওজন করা, লেখকের ব্যক্তিগত ব্যাধির সঙ্গে তাঁর সাহিত্যটির গোপন সম্পর্ক কতটা, তা ঠিক করা। চরিত্রগুলোর মধ্যে সমকামিতার সম্পর্ক কতটা কী আছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া—এ ধরনের কাজ কত আর করা যায়, ক্লান্ত না হয়ে? সাঈদ সাহিত্যকে দেখছেন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং তাকে রাখছেন সংস্কৃতির বড় এক ক্ষেত্রে। ফলে তাঁর সমালোচনায় এমন একটা চাঞ্চল্য ও নতুনত্ব প্রকাশ পেয়েছে, যা একাধারে সুস্থ ও লক্ষ্যযোগ্য। সাহিত্য সমালোচনার জন্য এ একটা পথ বটে; বেরিয়ে পড়ার, ব্যাপ্ত হওয়ার পথ।
কিন্তু সেটা প্রধান গুণ নয় সাঈদের এই বইয়ের। প্রধান গুণ সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র উন্মোচন। আমেরিকানরা এখন বলছে, ইতিহাস শেষ হয়ে গেছে; অর্থাৎ ইতিহাস পৌঁছে গেছে তার গন্তব্যে। তা ঠিক, পৃথিবী এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক অধিক পরিমাণে বিভক্ত ‘আমরা’ এবং ‘বাদবাকিরা’য়। আমরা, অর্থাৎ আমেরিকানরাও আছি, আর তোমরা, অর্থাৎ বাদবাকিরাও রয়েছে; আমরাই আসল, আমরাই মানদণ্ড, তোমরা আমাদের দ্বারা শিক্ষিত ও অনুপ্রাণিত। যোগ করা যায় যে ওই বিভাজন আগেও ছিল। প্রাচীন গ্রিকরাও বলত যে তারাই শুধু সভ্য, বাদবাকিরা বর্বর। কিন্তু সাঈদ দেখাচ্ছেন যে আজকের দিনে আমেরিকা যতটা আগ্রাসী, কেউ কখনো ততটা ছিল না। অর্থনৈতিক শোষণ তো আছেই, গণমাধ্যমের হামলাটাও কম নয়, সেই হামলায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর স্বাধীনতা আজ বিপন্ন। সেদিক থেকে ইতিহাস তার চূড়ান্ত জায়গায় গিয়ে পৌঁছে গেছে বৈকি; আমেরিকা আছে, আর আছে বাদবাকিরা।
মার্কিন উপন্যাস ‘মবিডিকে’ ক্যাপ্টেন আহাব নামে একটি চরিত্র আছে। তার এক পা নেই। অন্য পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে ‘মবিডিক’ নামের প্রকাণ্ড তিমি মাছটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে, হত্যা করবে। সাঈদ বলছেন, আহাব যেন আমেরিকারই মুখপাত্র। সারা পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্ব করবে সে। কোনো বাধা মানবে না। সাম্রাজ্যবাদ জিনিসটা কী? জোসেফ কনরাডের একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন সাঈদ, তাঁর বইয়ের শুরুতে। সেটিই বলে দেয় সাম্রাজ্যবাদের গোপন কথা। এ হচ্ছে পৃথিবী বিজয়, আর পৃথিবী বিজয় হলো আমাদের থেকে গায়েব রং যাদের ভিন্ন কিংবা নাক যাদের কিছুটা চ্যাপ্টা, তাদের কাছ থেকে পৃথিবীটাকে ছিনিয়ে নেওয়া। জিনিসটা দেখতে সুন্দর নয়। যা তাকে উজ্জ্বল করে, সে হচ্ছে অন্তর্গত একটি নৈতিক ধারণা। ক্যাপ্টেন আহাবের ক্ষেত্রে এ ধারণাটা হচ্ছে প্রতিহিংসা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ক্ষেত্রে সেটি হলো ‘আমরা শ্রেষ্ঠ’ এই বিশ্বাস। তারাই শ্রেষ্ঠ, সারা পৃথিবীর তারা মঙ্গল করছে। তাদের রুখবে কে?
না, রোখার মতো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এভাবে তো পৃথিবীটা চলতে পারে না। পৃথিবীকে মানুষের জন্য বসবাসের উপযোগী করতে হলে সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য থেকে তাকে মুক্ত করতে হবে। তার জন্য যেটা প্রয়োজন তা হলো—সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান। ওদিকে আবার সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান মোটেই সম্ভব হবে না, যদি না এই বোধের সৃষ্টি করা যায় যে কোনো সংস্কৃতিই বিচ্ছিন্ন নয়, সবাই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। একে অপরের কাছ থেকে তারা সর্বদাই সাহায্য নিয়ে থাকে।
কিন্তু যে প্রশ্নটির জবাব এডওয়ার্ড সাঈদ দিচ্ছেন না, অথচ যার জবাব খুবই জরুরি, সে হচ্ছে ওই যে—বোধের কথা বলছেন তিনি, সেটি সৃষ্টি হবে কী করে, কারা করবে সৃষ্টি। সৃষ্টি হবে কি দেশে দেশে বুদ্ধিজীবীদের সাম্রাজ্যবাদের কুফল ও কুৎসিত চরিত্র সম্পর্কে সজাগ করে? হ্যাঁ, সজাগ করা খুবই জরুরি। সজাগ না করলে কিছুই হবে না। কিন্তু কেবল জাগিয়ে দিলেই কি হবে? তা ছাড়া, কাদেরই-বা জাগাবেন? উদারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের তো? তাঁদের ক্ষমতা কতটা এবং কোথায়?
বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই যে সাদ্দাম হোসেন যেমন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিকল্প ছিলেন না, বিচ্ছিন্ন বুদ্ধিজীবীরাও তেমনি ওই সাম্রাজ্যবাদকে রোখার জন্য যথেষ্ট নন। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ-কবলিত বিশ্বের যে সাংস্কৃতিক সহাবস্থানের কথা বলেছিলেন সাঈদ, সেটা যে সম্ভবপর নয়—সাঈদের বই তো সে কথাটাই সবচেয়ে জোর দিয়ে বলছে। সহাবস্থান মানেই হচ্ছে অধীন হয়ে থাকা এবং সাংস্কৃতিক অধীনতা যে কতটা অমানবিক, এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর বইয়ে তা-ও দেখিয়েছেন, পরিচ্ছন্ন অথচ মর্মস্পর্শীরূপে। তাহলে কী করতে হবে?
কী করতে হবে, সে-কথাটা তাঁর বইয়ে বলা হয়নি; যা করতে হবে তা হলো, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া, তাকে পরাভূত করা। এ কাজে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা খুবই বড় হবে, কিন্তু তা একক হবে না, প্রয়োজন হবে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে জনগণের ঐক্য। এ ঐক্য দেশে দেশে গড়ে উঠবে। আর ওই ঐক্যের প্রয়োজনে সব দেশেই আবশ্যক হবে সামাজিক বিপ্লব। সামাজিক বিপ্লব না ঘটলে অধীন দেশগুলোর নেতৃত্ব রয়ে যাবে সাম্রাজ্যবাদের সমর্থকদের হাতে। তাতে সাম্রাজ্যবাদ মোটেই দুর্বল হবে না, এখন যেমন হচ্ছে না। রুশ বিপ্লবের পর পৃথিবীর নানা দেশে সামাজিক বিপ্লব ঘটছিল, সেই বিপ্লবের ধারাকে অব্যাহত না রেখে সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে কী করে আমরা মুক্তি পাব—এ কথা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বুদ্ধিজীবীরা যদি না বলেন, তবে কে বলবেন? কিন্তু বলছেন না তো।
এডওয়ার্ড সাঈদের বই সাম্রাজ্যবাদকে চিনতে সাহায্য করে এবং সেই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রয়োজন যে কত বেশি, তা-ও বলে দেয়। সমাধান না দিয়েও জানিয়ে দেয় সমাধান দেওয়াটা কত জরুরি।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়