রাজধানীর মানুষ বিশেষত বিত্তবানেরা যখন জৌলুশপূর্ণ কেনাকাটায় ব্যস্ত এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠন যখন নানা আঙ্গিকের ইফতার পার্টি আয়োজন নিয়ে রীতিমতো গলদঘর্ম হচ্ছে, ঠিক তখনই গত কয়েক দিনে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জের বিভিন্ন হাওরের বাঁধ ভেঙে পাহাড়ি ঢলের পানিতে ডুবে গেছে ওই সব অঞ্চলের বিপুল পরিমাণ জমির সমুদয় কাঁচা ও আধা পাকা ধান। এর আগে ১৬ এপ্রিল বাঁধ ভেঙে সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা অঞ্চলের বেশ কটি হাওরের কাঁচা ধান পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী দুই-চার দিনের মধ্যে এ ধরনের বাঁধ ভাঙার ঘটনা আরও ঘটতে পারে। এ অবস্থায় অবশিষ্ট বাঁধ ও ধান রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষ একত্র হয়ে প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে এবং ক্ষতির কথা জেনেও খেতের কাঁচা ও আধা পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে এটুকু প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় যে হাওরের ফসল রক্ষার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর চলমান দুর্নীতিপরায়ণ অস্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনা অব্যাহত থাকলে বাঁধ ভেঙে ফসল নষ্টের অনুরূপ ঘটনা একই ধারায় আগামী বছরগুলোতেও অব্যাহত থাকবে বৈকি!
১৯৪৬ সালের তেভাগা আন্দোলনের সময়ও আকস্মিক বন্যা থেকে বাঁচানোর জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও কৃষককে তাঁর জমির কাঁচা ধান অসময়ে কেটে ফেলতে হয়েছে। আজ ৭৬ বছর পরও এ দেশের কৃষককে সেই একই কাজ, একই রকম কষ্ট বুকে বেঁধে অবলীলায় করে যেতে হচ্ছে। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে আগে ক্ষতি হতো শুধু ধানের, এখন ধানের ক্ষতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতির ক্ষতিও (দুর্নীতির পেছনে ব্যয়িত অর্থ জনগণকেই বাড়তি কর দিয়ে পরিশোধ করতে হয়)। পরাধীন দেশে বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর জন্য কৃষকের পাশে তখন বলতে গেলে আর কেউই ছিল না। এখন তাঁর পাশে ‘সাহায্যে’র হাত নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিবাজ ও অদক্ষ প্রকৌশলী, অতিমুনাফালোভী ফাঁকিবাজ ঠিকাদার, জনবিচ্ছিন্ন প্রশাসন, আর ভোটকালের জনপ্রতিনিধি। তাঁরা না থাকলে কৃষক ধান কাটা বা না কাটার বিষয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, যেমনটি তাঁরা অতীতে নিয়েছেন এবং নিয়ে টিকেও থেকেছেন।
কিন্তু এখন অন্যরা এসে তাঁদের সেই স্বাধীনতাটুকুও ছিনিয়ে নিয়েছে। একপক্ষ এসে বলছে, চিন্তা করবেন না, অপেক্ষা করুন, আমরা আপনাদের পাশে আছি। আরেক পক্ষ এসে রীতিমতো মাইকিং করে বলছে, দ্রুত ধান কাটুন, নইলে সর্বনাশ।
এর বাইরেও আছে আরও ভয়ংকর নানা পক্ষ, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এই আতঙ্কের সুযোগে কৃষকের কাছ থেকে দাদনে কম দামে ধান কিনে নেওয়া ফড়িয়ার দল। সব মিলিয়ে ৭৬ বছরের ব্যবধানে আকস্মিক বন্যাকে ঘিরে কৃষকের আতঙ্ক শুধু বাড়েইনি, দিনে দিনে তা আরও জটিল হয়েছে।
এখন আত্মজিজ্ঞাসার জায়গা থেকে যদি প্রশ্ন করা যায়, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ যা যা অর্জন করেছে তার মধ্যে আকস্মিক বন্যার ভয়ে কাঁচা ধান কেটে ফেলার আতঙ্ক দূর করার সফল প্রয়াসটুকু নেই কেন? তাহলে এ সময়ের মধ্যে কার স্বার্থে কী অর্জন করলাম আমরা? স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির কোনো আলোচনায় আমরা কি কখনো এ ভয়াবহ অনর্জনগুলো নিয়ে কথা বলতে আগ্রহবোধ করেছি? যদি তা না করে থাকি, তাহলে সামনের বছরগুলোতেও যে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কুড়িগ্রাম বা আকস্মিক ঢলপ্রবণ দেশের অন্যান্য এলাকার কৃষকদের একই আতঙ্ক মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, তাতে বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এরূপ আকস্মিক ঢল বা বন্যার পানি থেকে ফসল বাঁচানোর কি স্থায়ী কোনো উপায় নেই? তাহলে যে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার এক বছরের কম সময়ের ব্যবধানে মানুষ এর প্রতিরোধক টিকা নিতে পারল, সেটি কীভাবে সম্ভব হলো? এক বছরের ব্যবধানে টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব হলে ৫০ বছরের ব্যবধানেও কেন হাওরের কৃষকের ফসল রক্ষার স্থায়ী সমাধান বের করা গেল না?
হাওরের ফসল রক্ষার স্থায়ী উপায় হিসেবে যেসব ব্যবস্থার কথা আলোচনায় আছে তার মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট নদীগুলোর উজানের বাংলাদেশ অংশে ব্যাপক মাত্রার খননকাজ চালিয়ে সেসবের পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং বঙ্গোপসাগরমুখী নদীর মাধ্যমে ঢল ও বন্যার পানি সমুদ্রে পাঠিয়ে দেওয়া। (আমি পানিবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী নই বলে এ বিষয়ে কোনো বিশেষজ্ঞ মতামতদানের এখতিয়ার নেই)। অন্যদিকে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে যা করা যেতে পারে তা হচ্ছে, হাওরাঞ্চলে পানি রক্ষা বাঁধ নির্মাণের যে রেওয়াজ বর্তমানে চালু আছে, সেগুলোর নির্মাণকাজ যথাসময়ে, অর্থাৎ বন্যা শুরুর অনেক আগেই শুকনো মৌসুমের মধ্যে সম্পন্ন করে ফেলা, যাতে ঢল নামার আগেই ওই সব বাঁধের মাটি স্থায়িত্ব পেতে পারে।
একই সঙ্গে ওই সব নির্মাণকাজকে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক উভয় প্রকার দুর্নীতি থেকে মুক্ত রাখতে হবে। তদুপরি এসব নির্মাণকাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন যাতে উপযুক্ত পেশাদারত্বের ভিত্তিতে ও পর্যাপ্ত গুণগত মানসম্পন্ন হয়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে, যা বর্তমানে প্রায় নেই বললেই চলে। আর এসব কার্যক্রমের সঙ্গে একেবারে আনুষ্ঠানিকভাবেই কৃষকদের যুক্ত করতে হবে এবং সত্যি কথা বলতে কি, সংশ্লিষ্ট কৃষকদের সরাসরি অংশগ্রহণ ব্যতীত এ ধরনের কার্যক্রম প্রায় কখনোই সফল হতে পারে না।
এবারে হাওরের ফসল বিশেষত ধানের আবাদ প্রসঙ্গে আসি। সন্দেহ নেই, উচ্চফলনশীল, বন্যাসহনীয়, নোনাপানিতে আবাদযোগ্য, খরাসহনীয়, স্বল্পপরিচর্যাপ্রবণ ইত্যাদি নানা জাতের ফসল ও ফসলের বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের অসামান্য অবদান রয়েছে। তো, তাঁরা কি হাওর অঞ্চলের কৃষকদের জন্য এমন কোনো ধানজাত উদ্ভাবন করতে পারেন না, যা তাঁদের কাঁচা ধান কেটে ফেলার বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে? তাঁরা কি এমন কোনো ধানবীজের সন্ধান দিতে পারেন না, যা আরও দুই সপ্তাহ আগে রোপণ করে সাত-দশ দিন আগে এর ফসল ঘরে তোলা যায়? কৃষি বিভাগ কি কৃষকদের ধানের বীজ বপন ও চারা লাগানোর কাজটি যথাসময়ে করার জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদানের কাজটি আরও নিবিড়ভাবে করতে পারে না? রাষ্ট্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য অংশীদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কি দাদনদারদের কাছে কম দামে অগ্রিম ফসল বিক্রি করার নিষ্ঠুর প্রথা থেকে হাওরের কৃষকদের মুক্ত করতে এগিয়ে আসতে পারে না?
জাতীয় সংসদে কত হালকা ধাঁচের বিষয় নিয়েই তো আলোচনা হয়। সে ক্ষেত্রে হাওরবাসী কৃষকের চিরকালীন এ দুঃখ নিয়ে খানিকটা আলোচনা কি হতে পারে না? দেশের নাগরিক সমাজের (সিভিল সোসাইটি) সদস্যরা কত নানা বিষয়ে তাঁদের মতামত দিচ্ছেন। তাঁরা কি মনে করেন না যে এটিও এমন একটি বিষয় যা নিয়ে কথা বললে হাওরাঞ্চলের লাখ লাখ প্রান্তিক মানুষ উপকৃত হয়? মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন সময়ে বহু বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে দেশের নানা শ্রেণি ও পেশার অসহায় সাধারণ মানুষের কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছেন। আমরা কি আশা করতে পারি যে হাওরবাসী কৃষকের ফসল রক্ষার স্থায়ী ব্যবস্থা কেন একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে করা হবে না, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সে মর্মে সংশ্লিষ্টদের প্রতি একটি রুল জারি করবেন?
সামনেই সাধারণ নির্বাচন। আমরা কি আশা করতে পারি যে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সুনির্দিষ্টভাবে জানাবে তারা ক্ষমতায় গেলে হাওরের উন্নয়নে পরবর্তী পাঁচ বছরে কে কী করবে? উপরিউক্ত প্রশ্নের জবাবগুলো কার কাছ থেকে কতটা পাওয়া যাবে, জানি না। তবে এটা নিশ্চিতভাবেই জানি যে হাওরের মানুষ গভীর কষ্টে আছে এবং তাদের সেই গুমোট বাঁধা কষ্ট জমতে জমতে অনেকটাই নিথর পাথরের রূপ ধারণ করে আছে, যেমনটি জমে পাথর হয়ে গেছে তাঁদের ব্যাপারে রাষ্ট্রের বিবেক।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা, শিল্প মন্ত্রণালয়