এই তো বছর দুয়েক আগে স্বাধীনতা পদক দেওয়ার সময় একটি নাম আলোচনায় এসেছিল। এস এম রইজ উদ্দিন আহাম্মদ নামে একজন সাহিত্যিক ২০২০ সালে ঘোষিত স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়ে গেলেন। যাঁরা কোনো না কোনোভাবে আমাদের সাহিত্যজগৎ নিয়ে কিঞ্চিৎ ধারণা রাখেন, তাঁরা এ নামটি আগে কখনো শোনেননি। তাঁর লেখা কোনো বই কারও নজরে পড়েছে কি না, সেটাও আমাদের জানা নেই। তারপর একসময় অনেকেই ভাবলাম, হয়তো আমাদের পড়াশোনায় ঘাটতি আছে। আমাদের অজান্তেই একজন অসাধারণ সাহিত্যিককে খুঁজে বের করেছে কমিটি।
এরপর যা হলো, তা নিয়ে কথা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। স্বয়ং বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান যখন বললেন, ‘এবার সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পেলেন রইজ উদ্দিন, ইনি কে? চিনি না তো। কালীপদ দাসই বা কে? হায়! স্বাধীনতা পুরস্কার!’
তখন টনক নড়ল অনেকের। সমালোচনার মুখে সংশোধিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই পুরস্কার বাদ দেওয়া হয়।
গত বছরের আরও একটি ঘটনা আলোড়ন তুলেছিল। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নবীরুল ইসলাম বুলবুলের ২৯টি বই ছিল সরকারি ক্রয় তালিকায়। সরকারি কর্মকর্তাদের জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাস বাড়াতে, পাঠাগার গড়তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যে তালিকা করেছিল, তা নিয়েই উঠেছিল বিতর্ক। নবীরুল ইসলামের বইগুলো কী করে সরকারি কর্মকর্তাদের জ্ঞানচর্চায় অবদান রাখত, সে আলোচনা এখানে নয়। আলোচনার বিষয় হলো, এই যে যেনতেনভাবে লাভবান হওয়ার জন্য নিজের ২৯টি বই তালিকায় গছিয়ে দেওয়ার প্রবণতা—এ থেকে আমরা বের
হব কী করে?
ভিন্নধর্মী আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনার উল্লেখ করলে মন্দ হয় না। ছাত্রলীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উদ্বোধকের বক্তৃতা দিচ্ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তাঁর বক্তৃতাকালেই মঞ্চটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। মঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত লোকজন ওঠায় মঞ্চ তা সহ্য করতে পারেনি, ভেঙে পড়েছে।
দুই
ওপরের দুটো ঘটনার সঙ্গে শেষ ঘটনাটিকে এক করেছে ওই একটি ব্যাপারই—নিজেদের সম্মান না করার প্রবণতা। ওপরের তিনটি ঘটনাতেই দেখা যাচ্ছে, নিজেকে জাহির করার একটা ব্যাপার রয়েছে। ছাত্রলীগের মঞ্চটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, কারণে-অকারণে অসংখ্য নেতা-কর্মীর সমাগম হয়েছিল মঞ্চে। মঞ্চের সামনে বসে বা দাঁড়িয়ে নেতাদের ভাষণ শোনার দিকে মন দেননি এই ‘বাড়তি’ নেতা-কর্মীরা। তাঁরা ভেবেছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রীর সঙ্গে ছবি থাকলে আখেরে এগোতে পারবেন অনেকটা পথ। তাই মঞ্চের সামনে না থেকে নেতার পাশে বা পেছনে থাকাটাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেছেন তাঁরা। (যেন টেলিভিশন ক্যামেরায় দেখা যায়, অথবা স্টিল ফটোগ্রাফে তিনি থাকেন)। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ভেঙে পড়েছে মঞ্চ।
নিজেকে সামলে নিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘এত নেতা আমাদের দরকার নেই। দরকার কর্মী। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য স্মার্ট কর্মী দরকার। যেকোনো অনুষ্ঠানে গেলে সামনের লোকের চেয়ে মঞ্চে লোক বেশি। এত নেতা কেন? নেতা উৎপাদনের এত বড় কারখানা আমাদের দরকার নেই। ছাত্রলীগ হোক কর্মী উৎপাদনের কারখানা। ঠিক আছে?’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এই বক্তব্য অনেক কিছুই জানিয়ে দেয়। সত্যিই যে আমাদের রাজনীতিতে নেতার জন্ম হচ্ছে কেবল, কর্মীর দেখা মিলছে কম, সেটা রাজনীতির ভবিষ্যৎকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার সময় কমিটির লোকেরা কেন নিজেদের ন্যূনতম সম্মান করেন না? এটা কি কেউ কারও ওপর চাপিয়ে দিতে পারে? কমিটির কেউ কি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিলেন? এ রকম নাম তালিকায় আসা বন্ধ করার উপায় নিয়ে কেউ কি ভেবেছেন? সামনে আবারও একুশে পদক আর স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে, আবার কোনো অঘটনের সম্মুখীন হতে হবে কি না, কে জানে!
তিন
সম্মান পাওয়া এবং দেওয়া—দুটোরই আকাল পড়েছে আজকাল। ‘সম্মান’ শব্দটির সঙ্গে বাস্তব জীবনের মিল নেই বলে ওটাকে ‘তামাদি’ ঘোষণা করা হয়ে গেছে হয়তো, যা আমরা অনেকেই খেয়াল করে দেখিনি। নিজের অতীত নিয়ে গর্ব করার মতো কিছু মাইলফলক প্রতিটি জাতিরই থাকে। বাড়িতে, স্কুল-কলেজে, সামাজিক যোগাযোগে, রাষ্ট্রীয় সভায় সেই দৃষ্টান্তগুলো তুলে ধরা হয়। বলা হয়, আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিকে ওপরে তুলে ধরেছিলেন যাঁরা, তাঁদের দেখানো পথেই এগোতে হবে এবং আমরা আমাদের সম্মান আরও ওপরে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
আমরা সে পথে হাঁটছি না বহুকাল। আমরা আমাদের প্রতিটি সম্মানের জায়গাকেই অপমান করেছি। সংগ্রাম করে অধিকার আদায়ের পথটি এখন খুব জনপ্রিয় নয়। অল্প আয়েশে নেতা বনে যাওয়া বরং সহজ। নেতা হতে গেলে এখন আর পড়াশোনা লাগে না। পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে, আমাদের করণীয় কী, সেসব নিয়ে ভাবারও প্রয়োজন নেই। দলের মূল নেতা যা বলবেন, সেটাই একমাত্র সত্য। আর কোনো সত্য নেই। এ কারণেই আমাদের দেশে সত্যিকার নেতার জন্ম হয় কম, চাটুকারে ছেয়ে যায় দেশ। এটা কেবল সরকারি দলের ক্ষেত্রেই সত্য নয়, এমনকি শুধু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই সত্য নয়, এই সত্য সামগ্রিকভাবে দেশের সব সেক্টরেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। করপোরেট অফিসগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখুন, সেখানে যিনি অধীশ্বর হয়ে বসে আছেন, তাঁর ক্ষমতাও সৃষ্টিছাড়া। তিনি যা ইচ্ছে তা করার অধিকার রাখেন। চাটুকারদের কেউ যদি কম প্রশংসা করেন, তাহলে তাঁর বিপদ। তাই চাটুকারিত্বে একে অন্যকে ছাড়িয়ে যান তাঁরা।
অনেকেই সংসদ সদস্যদের বক্তৃতার মধ্যে চাটুকারিতার প্রয়োগ দেখে বিরক্ত হন, কিন্তু করপোরেট অফিসগুলোয় সে প্রবণতা যে রাজনৈতিক দলগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে, সেটা খেয়াল করেন না। আমি নিজেই এমন একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম, যেখানে দেখেছি, প্রতিষ্ঠান-প্রধানকে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতাই সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিষ্ঠান-প্রধান হয়তো কর্মীদের মেইলে সাধারণ কোনো বার্তা দিয়েছেন, তার প্রতি-উত্তরে চলতে থাকে প্রশংসার তুবড়ি। বিষয়টি নাকি প্রতিষ্ঠান-প্রধান ছাড়া আর কেউ ভাবতেও পারতেন না। সামনাসামনি মিটিংয়ে চাটুকারেরা যা বলেন, তা যে নিজেরাই বিশ্বাস করেন না, তা বৈঠকের পর বাইরে এসে তাঁদের নিজেদের আলোচনা থেকেই জানা যায়।
এ রকম সংস্কৃতি আসলে নিজেদের সম্মানটাই নষ্ট করে, আর কিছু নয়। সেটা সময়মতো টের পাওয়া যায় না। যখন টের পাওয়া যায়, তখন আর করার কিছুই থাকে না।
চার
আমি বললাম, ‘ওহে, আমাকে সম্মান করো’ আর চারদিক থেকে সবাই আমাকে সম্মান করা শুরু করল, ব্যাপারটা আসলে অত সহজ নয়। সম্মান করার অর্থ হলো, সত্যিই ব্যক্তির ভেতরে এমন কোনো গুণ থাকতে হবে, যে গুণগুলোর সর্বজনীন ব্যাপ্তি আছে। ব্যক্তিটিকে আস্থায় নেওয়া যায়। মনে করা যায়, ব্যক্তিটি তাঁর কথায়, কাজে যে সংস্কৃতিবোধের পরিচয় দিচ্ছেন, সেটা বানানো নয় এবং সেটা শুধু ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এর সঙ্গে সামগ্রিক অগ্রগতির যোগসূত্র আছে।
মেকি কোনো ঘরানার সংস্কৃতিবোধের কথা বলা হচ্ছে না। শিক্ষার আলোবঞ্চিত মানুষের সংস্কৃতিবোধ হতে পারে অনেক উন্নত। তাঁকে যদি সম্মান করা হয়, তাহলে আশার আলো জ্বলে উঠতেই পারে। বিনয়হীন মানুষ যখন রুচিহীনভাবে কিছু নিয়ন্ত্রণ করে, আর তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো সাহস না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, আমাদের গোড়ায় গলদ। সেই গলদটাই আমাদের সুরুচিকে বিধ্বস্ত করেছে।
আমাদের সংকট হলো, আমরা ক্ষমতাকে সম্মান করছি—রুচি, ঐতিহ্য, নীতিকে নয়। এ কারণেই প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে এত ঘুষ-দুর্নীতি, রাস্তায় চলাচলের সময় ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা না করা, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার সময় দ্রুত অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার জন্য গলি-ঘুঁচির সন্ধান করা, বদলি, প্রমোশন ইত্যাদির জন্য পার্টির কারও পরিচয় দিয়ে অনায়াসে কথা বলার ভঙ্গি রপ্ত করা। অল্প কয়েকটি বিষয়ের কথা বলা হলো, কিন্তু এ থেকেই বোঝা যাবে, আমাদের পারস্পরিক সম্মানবোধ নষ্ট হয়ে সম্পর্কটা এখন একরৈখিক অভব্যতার দিকে চলমান। পরিবারে, বিদ্যায়তনে, কর্মক্ষেত্রে সুরুচি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ফিরিয়ে আনতে না পারলে এই প্রবণতাই গলার ফাঁস হয়ে রয়ে যাবে, যা থেকে উদ্ধার পাওয়া কঠিন।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা