গত শতকের ষাটের দশক থেকে আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের রাজনীতির বহু ঘটনার আমি সাক্ষী। অনেক উত্থান-পতন কাছে থেকে দেখেছি। কোনো কোনো ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িতও থেকেছি। এ পর্যন্ত দেশে ঘটে যাওয়া সব বড় ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এটা বলতেই পারি যে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে একেবারে কম পুঁজি সঞ্চিত নেই। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকেই দেশের বর্তমান রাজনীতি সম্পর্কে দু-একটা কথা বলতে চাই। বলে রাখা ভালো, আমি কোনোভাবেই তথাকথিত নিরপেক্ষ মানুষ নই।
আমার রাজনৈতিক মত আছে। তবে এটাও ঠিক যে, আমি মতান্ধ নই। ভালোটা গ্রহণ এবং খারাপটা বর্জনের উদার মানসিকতা আমার আছে। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেওয়ার কথা আমি কখনো ভাবি না।
আমি আমার ছয় দশকের রাজনৈতিক জীবনে অনেক সংকট যেমন দেখেছি, তেমনি সংকট কাটিয়ে রাজনীতিকে একটি গতির মধ্যে ফিরিয়ে আনার মতো বিচক্ষণ নেতৃত্বও দেখেছি। তেমন কোনো কোনো নেতার সঙ্গে একত্রে কাজ করার সুযোগও আমার হয়েছে। এখন বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে দৌড়ঝাঁপ খুব করতে না পারলেও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা থেকে বিরত নই। দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও অনেকের মতো আমাকেও পীড়িত করছে। খারাপ সময় কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তবে ভালো সময়ও আবার আপসেআপ আসে না। খারাপ সময়কে দূরে সরিয়ে ভালো সময়কে বরণ করার জন্য চেষ্টা থাকতে হয়, পরিকল্পনা থাকতে হয়। এখন ভালোর পক্ষে চলার চেষ্টা ও পরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হয়।
একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের রাজনীতির কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, কোনো শক্তি-গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি ছিল, শত্রু-মিত্র ছিল—সেটা যেমন দেশের ভেতরে, তেমনি দেশের বাইরেও। অন্য কোনো দেশের চিত্রটা ঠিক তেমন নয়। স্বাধীনতার ৫২ বছরে আমাদের যেমন অনেক অর্জন আছে, তেমনি কিছু পশ্চাদপসরণ আছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বিভক্ত আর বিপক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ। জাতীয় স্বার্থ নিয়েও আমাদের দেশের সব রাজনৈতিক দল একমত হতে পারে না। ঐক্যের চেয়ে বিরোধ আমাদের বেশি পছন্দ। ফলে সাধারণত কোনো একটি ইস্যুতেও আমরা এক হয়ে কথা বলতে পারি না। মতভিন্নতাকে আমরা মুখে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বললেও বাস্তবে ভিন্নমতকে বরদাশত না করাই আমাদের ধারা।
দেশে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা কীভাবে নিরসন হবে, সে বিষয়ে যাওয়ার আগে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত, এই সংকটটা কীভাবে তৈরি হলো?
বেশি অতীতে না গিয়ে আমরা নিকট অতীতের দিকে চোখ ফেরালে কী দেখি? আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নামক দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল যে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে আছে, সেটাও এক দিনে তৈরি হয়নি। এই দল দুটি কাছাকাছি আসার চেষ্টার চেয়ে দূরত্ব বাড়ানোর কাজটিই অব্যাহতভাবে করে চলেছে। এর জন্য কোন দলের দায় বেশি, সেই বিতর্কে না গিয়ে আমি আমার স্নেহভাজন সাংবাদিক মাহবুব কামালের একটি লেখা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি। মাহবুব কামাল লিখেছেন: ‘রাজনীতির বর্তমান সংকটের শুরুটা করেছে বিএনপিই। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংযোজিত হওয়ার পর এ দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের দলীয় সরকার প্রথমবারের মতো শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ২০০১ সালে। ১৯৯৬ সালে বিএনপি বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কাছে যে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল, সেটা শান্তিপূর্ণ নয়। প্রবল আন্দোলনের মুখে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত করে বিএনপি ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছিল। ২০০১ সালে শেখ হাসিনা যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় দিয়েছিলেন, তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার প্রয়োজন ছিল; কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা নেওয়ার পর সেই সংস্কৃতি আমলে নেয়নি। পরবর্তী, অর্থাৎ ২০০৬ সালের নির্বাচন ম্যানিপুলেট করার লক্ষ্যে প্রথম থেকেই তারা আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক বলে খ্যাত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করে তাদের দেশছাড়া করার অপচেষ্টা চালায়। এরপর ধর্মকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে ইসলামি জঙ্গিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। এতেও তারা আশ্বস্ত হতে পারেনি। ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনাকে হত্যার অপচেষ্টা চালায়। ওই অভিযানে ব্যর্থ হয়ে (যদিও ওই হামলায় আওয়ামী লীগের নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন) তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ম্যানিপুলেট প্রক্রিয়ায় হাত দেয়। এ প্রক্রিয়ায় একসময়কার বিএনপি নেতা কে এম হাসান যাতে ইমিডিয়েট পাস্ট প্রধান বিচারপতি হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হতে পারেন, সে জন্য বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো হয়। কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সংবিধানের আলোকে ওই পদের জন্য পরবর্তী অপশনগুলো যাচাই না করেই রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে যুগপৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করা হয়। তৈরি হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই প্রেক্ষাপটেই এক-এগারোর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখলেন আঘাতপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যন্ত্রণায় ধড়ফড়াচ্ছে। তিনি এই ধড়ফড়ানি সহ্য না করে এক কোপে ব্যবস্থাটির ধড় ও মুণ্ডু আলাদা করে তার কবরের শান্তি নিশ্চিত করলেন, অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। চারদলীয় জোট সরকার যদি শেখ হাসিনার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ২০০৬ সালে নিয়মতান্ত্রিক ইমিডিয়েট পাস্ট প্রধান বিচারপতির হাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করত, তাহলে এক-এগারোও ঘটত না, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও বহাল থাকত বলে অনুমান করি। দ্বিতীয় কথা, বিএনপির পাঠশালায় ছাত্রী হয়েই তো শেখ হাসিনা সহজে ক্ষমতা ছাড়তে চাননি, চাইছেন না এবং ক্ষমতার চর্চা করে করে তিনি এমন এক জায়গায় চলে গেছেন, বলা যায় সেটা রুবিকন নদীর ওই পাড়। রুবিকন একবার পার হয়ে গেলে আর এই পাড়ে আসা যায় না। নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও লোপ পায়।’
মাহবুব কামালের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে দ্বিমত পোষণের তেমন কিছু নেই। ২০০৮ সালে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসেছিল। কিন্তু বিএনপি পরাজয়কে সহজভাবে নিতে না পেরে যে রাজনৈতিক কৌশল নেয়, তা আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈরিতাই বাড়িয়ে তোলে। ২০১৪ সালে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নিত, আগুন-সন্ত্রাসের পথে না যেত, তাহলে একদিকে সংসদের ১৫৩টি আসনে আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পেত না, অন্যদিকে বিএনপিকেও সংসদীয় রাজনীতির বাইরে থাকতে হতো না।
রাজনীতিতে সবকিছুতেই বিরোধিতার যে অসুস্থ ধারা, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে এখন আওয়ামী লীগের কাছেই শুধু ছাড় বা নমনীয়তা প্রত্যাশা না করে বিএনপিকেও কিছু ছাড় দেওয়ার মানসিকতায় ফিরতে হবে।
লেখাটি শেষ করতে চাই বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি উল্লেখ করে। খালেদা জিয়া অসুস্থ। তাঁর বয়স হয়েছে। তিনি ক্ষমতায় থাকতে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে আচরণ করেছেন, সেটাকে কোনোভাবেই মানবিক বলা চলে না। প্রতিহিংসাপরায়ণতাই বিএনপির রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। অথচ জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপির দায়িত্ব খালেদা জিয়া নেওয়ার পর নতুনভাবে যাত্রা শুরু করার সুযোগ ছিল। বিশেষ করে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় দুই দল যুগপৎভাবে অগ্রসর হওয়ায় সমঝোতার রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ প্রশস্ত হয়েছিল। কিন্তু সংকীর্ণতার পথেই হাঁটা হয়েছে।
তবে সময় শেষ হয়ে গেছে বলে আমি মনে করি না। এখন খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর সুযোগ দিয়ে শেখ হাসিনাই পারেন একটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে। যদিও যুক্তরাজ্যের লন্ডনের মেথোডিস্ট সেন্ট্রাল হল ওয়েস্টমিনস্টারে গত সোমবার নিজের সম্মানে আয়োজিত একটি সংবর্ধনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বলেছেন, ‘রোজই শুনি এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়স তো আশির ওপরে। এমনিই তো সময় হয়ে গেছে, তার মধ্যে অসুস্থ। এখানে এত কান্নাকাটি করে তো লাভ নাই।’
দেশের মানুষ যে মানবিক, উদার শেখ হাসিনাকে চেনে, এই বক্তব্য তার সঙ্গে যায় না। বিষ পান করে যিনি নীলকণ্ঠ হয়েছেন, তাঁর কাছে মানুষের প্রত্যাশা সব সময় বেশি থাকে। খালেদা জিয়া তাঁর সঙ্গে প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করেছেন বলেই তিনি কেন নিজেকে রূঢ় হিসেবে উপস্থাপন করবেন? তাঁকে যারা হত্যার চেষ্টা করেছে, তারা এখন তাঁর কাছে দলীয় প্রধানের জীবন রক্ষার জন্য করুণাপ্রার্থী।
আইনের মারপ্যাঁচ নিয়ে বিতর্ক না বাড়িয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ করে দিলে রাজনীতিতে সমঝোতার বাতাবরণ সৃষ্টি হবে। এতে কারও ক্ষতির কিছু নেই, বরং লাভের সম্ভাবনা শতভাগ।
অন্তত বলা তো যাবে, ‘মারিলি কলসির কানা, তাই বলে প্রেম দিব না!’
মোনায়েম সরকার, রাজনীতিবিদ, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর