পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এরই মধ্যে গাজীপুরের নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হেরেছেন এবং ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুন। ৫৭টি ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদের মধ্যে বিএনপির স্থানীয় ১২ জন নেতা-কর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেছেন। ১৯টি সংরক্ষিত নারী আসনের মধ্যে ১টিতে বিএনপির স্বতন্ত্র নারী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। মেয়র পদে বিএনপি পরিবারের সদস্য বলে দাবি করা স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনুর ইসলাম রনি ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন। বিএনপি কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত প্রার্থীদের আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করেছে। তবে রনির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি।
বরিশাল ও খুলনা সিটি নির্বাচন ১২ জুন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় কামরুল আহসান রুপনকে আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। মোট ২১ জনকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কারণে বিএনপি থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলেও এ পর্যন্ত একজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বাকিদের ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। খুলনার প্রার্থীদের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। ২১ জুন সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সিলেটে মেয়র পদে সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন বর্তমান মেয়র আরিফুল হক। কিন্তু তিনি দলের গ্রিন সিগন্যাল না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত নিজেকে গুটিয়ে নেন। সিলেটে কাউন্সিলর পদে বিএনপির ২৫ জন নেতা-কর্মী অংশগ্রহণ করায় তাঁদের আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। রাজশাহীর প্রার্থীদের বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়, তবে বিএনপি কতটা হার্ডলাইনে আছে তা অন্যান্য সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে স্পষ্ট। অন্যান্য সিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত একই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে এ পর্যন্ত যেসব উপনির্বাচন এবং স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে অনিয়মের অভিযোগ খুব বেশি একটা পাওয়া যায় না। নির্বাচন কমিশন এ পর্যন্ত নির্বাচনকে বিতর্কমুক্ত রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার পরও বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে বিএনপি প্রথম থেকেই গ্রহণ করেনি।
উপনির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, ভোটাধিকার প্রয়োগে নারী-পুরুষ সবাইকে সচেষ্ট হতে দেখা গেছে। ভোটের ব্যাপারে তেমন কোনো বিশেষ অভিযোগ শোনা যায়নি। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ৪৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। এটি মোটেও কম নয়। এই আসনে বহিরাগত বহু ভোটার থাকেন, যাঁরা চাকরির সুবাদে কিছুকাল থাকলেও পরে চলে যান, সে কারণে গাজীপুরের মোট ভোটারের একটা বড় অংশই পাঁচ বছর পর এই অঞ্চলে না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। নতুন যাঁরা আসেন, তাঁরা নতুন ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় থাকেন বা অনেকের বিলম্ব ঘটে। সুতরাং গাজীপুরের ভোট শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছে—এ কথা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, অন্য চার সিটি করপোরেশনেও নির্বাচন প্রায় একই রকম হবে। বিএনপি অংশগ্রহণ করলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্রতর হতো, জয়-পরাজয়ে হেরফের ঘটত। কিন্তু নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আপাতত তেমন কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না। এর পরও বিএনপি এই নির্বাচন কমিশন এবং এই সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে অটল যেমন রয়েছে, একইভাবে দলের সব নেতা-কর্মীকে নিবৃত্ত রাখার জন্য বহিষ্কারের খড়্গ হাতে তুলে নিয়েছে। কিন্তু বিএনপি সমর্থিত ভোটারদের সবাই কি ভোটদানে বিরত থাকছেন? গাজীপুরের খবরাখবর তো তা বলে না। তাঁরা কে কোন প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন, তা তাঁদের বিষয়, আমাদের জানার কথা নয়। কিন্তু দলের এমন কঠোর মনোভাব অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে।
বিএনপি এই মুহূর্তে বিদেশি দূতাবাস ও কূটনীতিকদের সঙ্গে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ঘন ঘন বৈঠক করছে। সেটি জাতীয় সংসদের নির্বাচন, যেখানে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের ওপর সরকার গঠনের বিষয়টি অনেকটাই সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে। এসব বৈঠকের ক্ষেত্রে মার্কিন দূতাবাসের অবস্থান যেমন সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত, একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিসা ইস্যু, ছয়জন কংগ্রেসম্যানের চিঠি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বক্তব্য ইত্যাদি বিষয় এখন আলোচনার শীর্ষে অবস্থান করছে। এবারই প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ আগে থেকেই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সোচ্চার। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের প্রধান পিটার ডি হাস এখন সবচেয়ে আলোচনার শীর্ষে আছেন। বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের বৈঠক বেশি হচ্ছে। কোনো কোনো বৈঠকের ব্যাপারে বিএনপি মুখ খুলছে না। মার্কিন দূতাবাস কূটনৈতিক ভাষায় কিছু কথা বলে, যা সবারই বোধগম্য; কিন্তু বিএনপি নেতাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হয়, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যদের সঙ্গে কথা বলে এবার খুবই আশাবাদী যে আগামী নির্বাচন তাঁদের দাবি মোতাবেকই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে!
ঢাকার কূটনীতিক এলাকার অনেক কথাই প্রতিদিন ভেসে আসছে। কূটনীতিপাড়ার ভেসে আসা এই খবর যেন কারও জন্য উল্লাসের, আবার কারও জন্য বিমর্ষের। কিন্তু এ সবই যেন সাদাকালো ছাই রঙের মতোই উড়ে বেড়ায়। এর কোনটা বিশ্বাসযোগ্য, কোনটা অবিশ্বাসযোগ্য, তার কিছুই বোঝার উপায় নেই। এখানে যে একটা কল্পিত উত্তেজনা ছড়ানো হচ্ছে, জনগণের মধ্যে গুজব ছড়ানোর ব্যবস্থা হচ্ছে, নিজেদের মর্যাদাকে ভুলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে, সেটা বুঝতে কজনই-বা বিবেক খরচ করছেন?
এমন এমন সব কথা শোনা যায়, যা শুনে পিলে চমকাতে হয়। ছয় মার্কিন কংগ্রেসম্যানের চিঠি পড়ে তো বোঝাই যাচ্ছে না তাঁরা বাংলাদেশ সম্পর্কে আদৌও সঠিক কোনো ধারণা রাখেন কি না। সবকিছুই তো ঘুরে বেড়ানো ও অপপ্রচার ছড়ানো নানা মিথ্যাচারের কাটিং পেস্টিং। শেখ হাসিনার সরকারের সময় যদি হিন্দু জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে, তাহলে নিশ্চয়ই বলতে হবে, এই সময়ে বড় ধরনের দাঙ্গাহাঙ্গামা সৃষ্টি হয়েছিল। এই হিন্দুরা তাহলে গেল কোথায়? ভারত কি নীরবে তা হজম করে নিয়েছে? এখানে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ধর্মীয় অনুভূতির নাম করে হিন্দু সম্প্রদায়ের কারও কারও নামে ভুয়া স্ট্যাটাস দিয়ে কিছু কিছু উত্তেজনা তো ছড়িয়েছিলই, কিন্তু এমন ঘটেনি যে এখান থেকে সংখ্যালঘুর দেশত্যাগ করতে হয়েছে, বরং সংখ্যালঘুর দেশত্যাগের ঘটনা ১৯৭৫-এর পর থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ক্রমাগত ঘটেছে। ২০০১-এর পরেও এখানে সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণ, মন্দির-গির্জা পোড়ানো, বিরোধীদের গ্রেনেড মেরে হত্যা করার ঘটনা ’৭১-এর বীভৎস চেহারার পুনরাবৃত্তির মতোই ঘটেছিল।
কংগ্রেসম্যানদের সেই দাবির প্রতি যদি জো বাইডেন সরকারের সমর্থন থাকে, তাহলে তো সভ্যতার ইতিহাস থেকে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সততা, অসাম্প্রদায়িকতা, এই বাংলাদেশে বিদায় নিতে খুব বেশি পায়ের নিচে খুঁটি পাবে না। সে ধরনের কিছু ঘটিয়ে বাংলাদেশে যাঁরা ক্ষমতায় আসবেন, তাঁরা দেশে স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্রবিধান কিংবা রাষ্ট্র মেরামত করার প্রতিশ্রুতি রক্ষার নামে কার্যত আফগানিস্তানের তালেবানি পতাকাই আমাদের দেখাতে যাচ্ছেন বলে মনে হয়।
দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করতে কিংবা বাস্তবায়ন দেখতে খুব বেশি দেনদরবারের প্রয়োজন নেই। নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল যার যার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার অবস্থান গ্রহণ করলেই জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ভোটাধিকার প্রয়োগে এগিয়ে আসতে কারও কোনো বাধাই কাজে লাগবে না। পরিস্থিতি এখন সেদিকেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটিকে কেউ এখন বুঝতে ভুল করলে বাংলাদেশ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা গোষ্ঠীর হাতের মুঠোয় আবদ্ধ হয়ে গেলে ভবিষ্যৎ মোটেও কারও জন্য সুখকর হবে না।