ময়মনসিংহে বিবাহবিচ্ছেদের হার বাড়ছে। গত বছর জেলায় দৈনিক গড়ে বিবাহ হয়েছে ৫৬টি। এর বিপরীতে দিনে গড়ে বিচ্ছেদ ঘটে ১৮টি। বিচ্ছেদের এই হার প্রায় ৩২ শতাংশ। এর পেছনে নৈতিকতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, যৌতুক, দাম্পত্যজীবনে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, অপরিণত বয়সে বিবাহ ও তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারসহ বেশ কয়েকটি কারণ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
ময়মনসিংহ জেলা সাবরেজিস্ট্রারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে জেলায় বিবাহ হয়েছে ২০ হাজার ২১৩টি। এর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটেছে ৬ হাজার ৩৯০টি। দৈনিক গড়ে ৫৬ বিবাহ এবং ১৮টির মতো বিচ্ছেদ হয়েছে। শতকরা হিসাবে বিচ্ছেদের হার প্রায় ৩২ শতাংশ। ২০২১ সালে ১৯ হাজার ৯৩৩টি বিবাহের মধ্যে বিচ্ছেদ হয় ৫ হাজার ৯১১টি। ২০২০ সালে ২১ হাজার আটটি বিবাহের বিপরীতে বিচ্ছেদ ঘটে ৫ হাজার ৫৩২টি।
পরকীয়া, দারিদ্র্য এবং যৌতুকসহ বেশ কয়েকটি কারণে প্রতিনিয়ত বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে বলে মনে করেন ময়মনসিংহ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী নাওরীন সুলতানা নীলা। এই আইনজীবী বলেন, আইনি পেশার সুবাদে প্রতিদিনই বিবাহবিচ্ছেদের একাধিক ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছেলেমেয়ের বিবাহের বয়স না হলেও প্রেমে পড়ে আদালতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। এই বিবাহের বেশির ভাগ বছর, ছয় মাস যেতে না যেতেই বিচ্ছেদে রূপ নেয়। বিচ্ছেদ কমানোর জন্য কাউন্সেলিং প্রয়োজন রয়েছে। অন্যথায় সমাজে বিচ্ছেদ ভয়াবহ রূপ নেবে।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ময়মনসিংহ কার্যালয়ের উপপরিচালক নাছিমা খাতুন পারিবারিক বন্ধনে দূরত্ব সৃষ্টির পাশাপাশি মানুষের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়া বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন। নাছিমা খাতুন বলেন, একটা সময় গ্রামের মানুষের মধ্যে শ্রদ্ধা-ভক্তি ছিল। এখন সেসব আর খুব একটা দেখা যায় না। পাশাপাশি স্মার্টফোনের ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় বিচ্ছেদও বাড়ছে। কারণ, একটা ছেলেমেয়ে ইচ্ছা করলেই ঘরে বসে একে অপরের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করতে পারছে। বেশি যোগাযোগ করতে গিয়ে ভালো লাগা থেকে প্রেম, বিবাহ বা পরকীয়ায় লিপ্ত হচ্ছে।
ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার মাছুম আহাম্মদ ভূঞা বলেন, বিবাহবিচ্ছেদের নেপথ্যে নৈতিকতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং স্ত্রীকে রেখে প্রবাসে দীর্ঘদিন থাকা উল্লেখযোগ্য কারণ। এ ছাড়া অপরিণত বয়সে আবেগে বিবাহ করাও বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। এ জেলার অনেক মানুষ বিবাহের পর প্রবাসে চলে যান। এ কারণে অন্যান্য জেলার তুলনায় ময়মনসিংহে বিচ্ছেদের হার বেশি। কারণ, একাকিত্ব দূর করতে অনেক নারী অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। তবে জেলায় বিট পুলিশিং জোরদার করায় নারী নির্যাতনের পাশাপাশি বিবাহবিচ্ছেদ কিছুটা হলেও কমছে।
মাছুম আহাম্মদ ভূঞা আরও বলেন, বিবাহবিচ্ছেদ কমিয়ে আনতে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে।
ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারজানা ইয়াসমিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অবাধ ব্যবহার, যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়া, অপ্রাপ্ত বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণে বিচ্ছেদ বাড়ছে। পারিবারিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে মানুষকে গুরুত্ব দিলে সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ অনেকাংশে কমে যাবে।