সৎ থাকার নিদান আমরা প্রায় সময়ই পাই। রাষ্ট্র থেকে শুরু করে সমাজ, পরিবার, শিক্ষায়তন—সব জায়গাতেই আমাদের সততা শেখানো হয়। বলা হয়, সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। কিন্তু এসব শিক্ষা পাওয়ার পর একজন মানবসন্তান যখন নিষ্ঠুর সমাজে এসে পদে পদে অসৎ হওয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দীক্ষা বা পরামর্শ পায়, তখন সে কী করবে?
কোনো মানুষই অসৎ হয়ে জন্মায় না। একটি শিশু তা-ই শেখে, যা তাকে শেখানো হয়। এই শেখানোর প্রক্রিয়া সর্বোৎকৃষ্ট হয়, যখন শিশুটির চারপাশের পরিবেশ সেই সততার চর্চার সহায়ক হয়। শিশুটি যখন ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, তখন একটা সময় সৎ থাকার সংগ্রামটা একান্তই তার নিজের হয়ে দাঁড়ায়। ওই সময়টায় যদি সে দেখে সততার জন্য রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে পুরস্কৃত হওয়ার ব্যবস্থা আছে, তখন সৎ থাকার আকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিকভাবেই উৎসাহিত হয়। আর এভাবেই একটা সমাজ, একটা রাষ্ট্র বা একটা জাতি একসময় পরিপূর্ণ সৎ হয়ে উঠতে পারে। কারণ, তখন সেখানে সৎ মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে।
অথচ আমাদের দেশে সততার মাত্রা বৃদ্ধির পথটাই যেন রুদ্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এর জন্য বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। এবারের প্রস্তাবিত বাজেট দেখলেই তৃতীয় চক্ষু খুলে যাওয়া সম্ভব। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে কালোটাকার মালিক প্রকারান্তরে অবৈধভাবে যাঁরা রোজগার করছেন, তাঁদের জন্য আছে এন্তার সুযোগ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের কোনো পক্ষ থেকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না বলেও নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না এনে ১৫ শতাংশ ও অস্থাবর সম্পত্তি ১০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এর আগের বেশ কয়েকটি বাজেটে পর পর কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এবারও তা আছে রূপ বদলে, ওই নতুন বোতলে পুরোনো ঘি রাখার মতো আর কি!
অর্থাৎ, পুরো বিষয়টি হচ্ছে অনেকটা অবৈধ কাজকে বৈধতা দেওয়ার মতো এবং একটা দেশে যখন এক যুগের বেশি সময় ধরে লাগাতার এমন সুবিধা আসতে থাকে, তখন বুঝতে হবে সরকার আসলে সৎ ও অসৎ–এর মাঝখানে থাকা সীমারেখায় আর ভারসাম্য রাখতে পারছে না। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে যেন বলা হচ্ছে, যেকোনো উপায়ে পয়সা কামাও, পরে দেখা যাবে পরের বিষয়!
কেন এ ধরনের কথা উঠছে, সেটি বুঝতে আমাদের ওই বাজেটের দিকে তাকালেই হবে। এবার ম্যাঙ্গো পিপলের বিষয়ে আসুন চোখ বোলাই। প্রস্তাবিত বাজেটে দ্বিশতক টাকায় সয়াবিন তেল কেনা মধ্য ও নিম্নবিত্তের জন্য কোনো সুখবর নেই। তাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি। অথচ উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ব্যয় বেড়েই চলেছে। বাটারবান কিনে পেট ভরাতেও এখন বেশি টাকা খসে। বিত্তের দিক থেকে তালিকার নিচের দিকে থাকা এই মানুষদের গৃহস্থালি ব্যয় আরও বাড়বে বাজেটের কারণে। বাকি দিলে খাজনা, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ফ্রিজ কিনে কম দামে একটু বেশি পরিমাণে আলু, পটোল কিনে তাতে রাখবেন, সেটিও করা কঠিন। কারণ, ফ্রিজের দামও বাড়বে। ওদিকে প্রযুক্তিতে শিক্ষিত হয়ে নিজেদের দক্ষতা বাড়ানোর বিষয়টিও ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াবে, কেননা মোবাইল, ল্যাপটপের দামও বাড়বে। আবার পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণ বা একই পরিমাণ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনলেই দিতে হবে আয়কর রিটার্ন। ধার করে ঘি খেতে চাইলেও (মানে ক্রেডিট কার্ড) স্বস্তি নেই, আবারও করের ফাঁদে পড়তে হবে। কী ভাবছেন, ব্যাংকে টাকা রেখে সুদে সংসার চালাবেন? কর দিতে হবে কিন্তু!
ঠিক এমন একটা সংকটময় পরিস্থিতির শিকার মানুষের মধ্যেই সততা-অসততার মধ্যকার নো ম্যানস ল্যান্ড প্রতিনিয়ত সংকুচিত হতে থাকে। আপনি যখন সংসার চালাতে হিমশিম খাবেন, নুন আনতে পান্তা ফুরাবে, প্রিয়জনদের সামান্য আবদার টাকার অভাবে পূরণ করতে পারবেন না এবং সেই সঙ্গে দেখবেন কীভাবে পাশের বাড়ির পি কে হালদারদের জন্য এ দেশটা লালগালিচার ব্যবস্থা করছে এবং সরকারি নীতিনির্ধারকেরা বলছেন কালোটাকা ‘রূপে কালো, গুণে আলো’—তখন একসময় মনে হতেই পারে,
‘সৎ থেকে বছর বছর নিয়মিত কর দিয়ে কী ছাতার মাথাটা পাচ্ছি?’
এই প্রশ্ন উঠতেই পারে; কারণ সরকারি যেকোনো কাজে এখানে কোনো দিন দুর্নীতির শিকার হননি, এমন কাউকে পাওয়া যাবে না। সরকারি সেবা নিতে গিয়ে কখনো হয়রানির শিকার হননি, এমন কোনো সাধারণ মানুষ পাওয়া যাবে না। সরকারি কাঠামোতে কখনো না কখনো বৈষম্যের শিকার হননি, এমন কোনো আমজনতা পাওয়া যাবে না। ফলে এ দেশের সৎ থাকা সাধারণ মানুষ যদি সততার ওপর বীতশ্রদ্ধ হতে থাকেন, তবে তাঁদের কি দোষ দেওয়া যাবে?
না, যাবে না। কারণ সততা ততক্ষণই টিকে থাকে, যতক্ষণ সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক থাকে। এটি ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি শাশ্বত সরকার ও জনগণের মধ্যেও। ২০১৮ সালে একটি গবেষণা করেছিলেন চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছিল, সামাজিক বিভিন্ন স্তরের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক ধরে রাখে প্রতিশ্রুতি। এটি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে আস্থার ভিত তৈরি করে। আর এই আস্থা পরে ছড়িয়ে পড়ে সমাজ থেকে রাষ্ট্র—সর্বত্র। উদাহরণস্বরূপ, একজন রাজনীতিবিদের কথা ধরা যাক, যিনি ভোটারদের অর্থনৈতিক উন্নতি আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হলেন। তাঁর ওই প্রতিশ্রুতির কারণেই এক অর্থে একটি অফিসের একজন সাধারণ কর্মী সঠিক সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করবেন, কারণ সার্বিকভাবে তাঁর মনে ওই আশার সঞ্চার হয়েছে যে—সৎপথে পরিশ্রম করলে অর্থনৈতিক উন্নতি আসবে। ফলে এ রকম প্রতিশ্রুতি একধরনের সামগ্রিক আশার সঞ্চার ঘটায়। তবে এটিও ঠিক যে সব প্রতিশ্রুতি সব সময় রক্ষা করা সম্ভব হয় না। আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হলেই তার প্রভাব পড়ে ব্যক্তিগত, সামাজিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক বিষয়াবলিতেও এবং সেই প্রভাব পুরোপুরি নেতিবাচক হয়। ২০০১ সালে প্রকাশিত ‘ট্রাস্ট অ্যান্ড গ্রোথ’ নামে নিজেদের গবেষণাপত্রে তেমনটাই জানিয়েছিলেন পল জে জাক ও স্টিফেন ন্যাক।
আমাদের দেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই আস্থার সম্পর্কটিতেই চিড় ধরেছে। কারণ, আমরা মাথাপিছু আয়ের উল্লম্ফনের ও উন্নয়নের গরিমায় গরবিনী হওয়ার এক অসম প্রতিযোগিতায় চিড়েচ্যাপ্টা হতে হতে লাগাতার শুনতে পাচ্ছি অবৈধকে বৈধ করার আদরণীয় সরকারি উদ্যোগের খবর। ফলে ঠিক-বেঠিকের নিক্তি উল্টো ফল দেখানোর অবস্থায় খাবি খাচ্ছে। আর ঠিক সেই সময়েই ঘটে যেতে পারে সর্বগ্রাসী সর্বনাশ, যখন সততা ক্লাউন সেজে চলে
যাবে জাদুঘরে!
শেষটা করি হারুনকে (ছদ্মনাম) দিয়ে। ১২ বছরের ছেলেটার সঙ্গে কদিন আগে চায়ের স্টলে দেখা, অস্ফুটে চাল চেয়েছিল ২ কেজি। সব ব্যবস্থা হওয়ার পর বিদায়ের কালে নিচু স্বরে জানিয়েছিল, ‘একটা কাজ দেবেন? আমার ভিক্ষা করতে ভালো লাগে না।’
বিশ্বাস করুন, এ দেশের বেশির ভাগ সৎ মানুষের ভিক্ষা করতে ভালো লাগে না। তবে তাদের হাতে ভিক্ষার থালা তুলে দেওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করলে, শেষে নিজের পেট বাঁচাতে কিন্তু সততার মাথাটিই কাটা পড়বে আগে! জনে জনে হেথায় জিজ্ঞাসিবে, ‘আমি সৎ থাকব কেন?’