দ্রুত পরিসংখ্যান ঘেঁটেঘুঁটে খুব বেশি পাওয়া গেল না। ১৯৭৩ সালে শুরুর পর গত অর্ধশতাব্দীতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ফুটবলে জয়ের সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা বলার সুযোগ নেই। তবে কোণঠাসা বাঘের মতো লড়াকু এক বাংলাদেশ দলের প্রত্যাবর্তনের পর পরিসংখ্যান খুঁজতে গিয়ে বেঙ্গালুরুতে আসা বাংলাদেশি সাংবাদিকদের প্রায় গলদঘর্ম অবস্থা।
তবু এই ‘মধুর’ সমস্যা সত্যি উপভোগ্য হয়ে ওঠে, যখন জিততে ভুলে যাওয়া একটি দল ব্যর্থতার চোরাবালি থেকে জেগে উঠে রঙিন গল্প লেখে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে গতকাল বেঙ্গালুরুর শ্রী কান্তিরাভা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের সামনে প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা মালদ্বীপ ১ গোলে এগিয়ে থাকার পরও ঘুরে দাঁড়িয়ে ৩-১ গোলে জয় এনে দিয়েছেন রাকিব-তারিক-মোরসালিনরা। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে মালদ্বীপের বিপক্ষে নিজেদের আরেকটি জয় পেতে বাংলাদেশের অপেক্ষা করতে হলো ২০ বছর, সর্বশেষ জয়টি ২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে।
বাংলাদেশের ৫০ বছরের ফুটবল ইতিহাসে এক গোলে পিছিয়ে থাকার পর ৩-১ গোলে জয় পাওয়ার ঘটনা এর আগে ঘটেছে একবারই। ১৯৯৯ সালে আরব আমিরাতে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩৪ মিনিটে গোল হজমের পর জিতেছিলেন মোনেম মুন্নারা। সাফ গেমসে সোনা জেতা সেই দলের কাছে এমন প্রত্যাবর্তন খুব বেশি অপ্রত্যাশিত ছিল না, যতটা ছিল জামালদের গতকালের দল নিয়ে। যে দল গোল করতে পারে না, ঠিকভাবে সামলাতে পারে না নিজেদের রক্ষণ, সেই দল যে পিছিয়ে পড়ার পরও মালদ্বীপের মতো কঠিন প্রতিপক্ষকে যেভাবে গুনে গুনে ৩ গোল দিল; একটু অবিশ্বাস্যই কি নয়!
মালদ্বীপ দল তবু শ খানেক সমর্থকের সমর্থন পেয়েছে গ্যালারিতে। গতকাল বাংলাদেশ এমন একটা মাঠেই খেলতে নেমেছে, যেখানে সাহস কিংবা অনুপ্রেরণা দেওয়ার মতো একজন সমর্থকও ছিল না লাল-সবুজ পতাকা হাতে। পরিসংখ্যানও ছিল না পক্ষে। টুর্নামেন্টে নিজেদের ম্যাচে লেবাননের কাছে হেরে আত্মবিশ্বাস ছিল তলানিতে। জামালদের ছিল শুধু একটা করণীয়, ‘হয় লড়ো নয় মরো’।
ম্যাচের শুরুতেই আবার ধাক্কা হামজা মোহাম্মদের। ১৮ মিনিটে নিজেদের প্রথম আক্রমণ থেকে হামজার ডান পায়ের কোনাকুনি শটে হার মানেন বাংলাদেশ গোলরক্ষক আনিসুর রহমান জিকো। গোল খেয়ে ম্যাচ জেতার ইতিহাস এই শতাব্দীতে না থাকায় দেশের ফুটবল সমর্থকদের এখানেই হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু হাল ছাড়েননি বাংলাদেশের ফুটবলাররা। সেখানেই ঘুরে দাঁড়ালেন অবিশ্বাস্যভাবে। বল পজিশন থেকে শুরু করে আক্রমণ, বাড়তে থাকে বাংলাদেশের গোলের সম্ভাবনা।
অবশেষে দলকে সমতায় ফেরান রাকিব হোসেন, যিনি কি না আগের ম্যাচে মাত্র চোট থেকে ফিরেছেন। বিশ্বনাথের দ্রুত এক থ্রো থেকে বক্সে বল বাড়ান সোহেল রানা। সোহেলের বাতাসে বাড়ানো বলে হেডে রাকিবকে বল বাড়ান তপু। ফাঁকাতেই ছিলেন রাকিব। তপুর হেড থেকে মাথা ছুঁয়ে বাংলাদেশ শিবিরকে আনন্দে ভাসান রাকিব। এই গোলের পরই খেলায় ফেরা শুরু বাংলাদেশের। গতি বাড়ে আক্রমণে। ৪৫ মিনিটে রাকিবেরই আরেক শট কর্নারের বিনিময়ে ঠেকান মালদ্বীপ গোলরক্ষক। কর্নার থেকে তপুর হেড ফিরিয়ে দেয় মালদ্বীপের রক্ষণ।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই আক্রমণে বাংলাদেশ। ৪৭ মিনিটে কর্নার থেকে উড়ে আসা বলে ফাঁকায় বল পেয়েও ক্রস বারের ওপর দিয়ে বল বাইরে পাঠান বিশ্বনাথ ঘোষ। সমতায় থাকলেই হতো না, বাংলাদেশকে করতে হতো জেতার মতো গোল। সেই গোল এনে দিলেন তারিক কাজী। আগের ম্যাচে তাঁরই ভুলে লেবাননের কাছে হেরেছিল বাংলাদেশ। গতকাল এই সেন্টার ডিফেন্ডার করলেন সেটির শাপমোচন। ৬৭ মিনিটে ইব্রাহিমের কর্নার থেকে বল গ্রিপে নিতে ব্যর্থ হন মালদ্বীপ গোলরক্ষক। বল বাতাসে ভাসা অবস্থায় হেড নেন তপু। বল পান ডান পোস্টে দাঁড়ানো তারিক কাজী। প্রথম দফায় তারিক শট নিলেও সেই শট ঠেকান ইব্রাহিম আইসাম। ফিরতি বলে আবারও তারিকের শট ফেরে গোললাইন থেকে। সেখান থেকে তৃতীয় দফায় হেডে বল জালে জড়িয়ে উদ্দাম উদ্যাপনে মাতেন তারিক। তাতে জাতীয় দলের হয়ে তাঁর দ্বিতীয় গোলটা হয়ে থাকল স্মরণীয়।
এগিয়ে থাকলেও ছিল না স্বস্তি। শেষ ১০ মিনিটে বাংলাদেশ শিবিরে ভর করে গোল খাওয়ার ভূত। এবার দৃশ্য উল্টো। দুই ম্যাচ আগেই অভিষিক্ত হওয়া মোরসালিন মালদ্বীপের ম্যাচে ফেরার সামান্য সম্ভাবনাও ধূলিসাৎ করে দেন। বিশ্বনাথের পাস ধরে ডান পায়ের জোরালো শটে মালদ্বীপের ফেরার রাস্তা বন্ধ করে দেন তরুণ এই মিডফিল্ডার। আর তাতে বাংলাদেশের নিশ্চিত হয় স্মরণকালের স্মরণীয় এক জয়।
এই জয়ে ২০০৯ সালের পর অর্থাৎ ১৪ বছর পর আবারও সাফের সেমিতে খেলার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলো বাংলাদেশের। শেষ চারে উঠতে হলে আগামী পরশু ভুটানকে হারালেই চলবে জামালদের। অবশ্য তারিক কাজী ও রাকিব চোটে পড়ায় খানিকটা দুশ্চিন্তা বাংলাদেশ শিবিরে। ভুটানের বিপক্ষে ড্র করলেও থাকবে সম্ভাবনা। সে ক্ষেত্রে লেবাননের কাছে হারতে হবে মালদ্বীপকে। সমীকরণের মারপ্যাঁচ ভুলে যদি শুধু গতকাল বাংলাদেশের ম্যাচটার দিকে তাকানো যায়, বেঙ্গালুরুর শ্রী কান্তিরাভা স্টেডিয়ামের সবুজ গালিচায় পড়ে রইল একরাশ বিস্ময় আর মুগ্ধতা।