রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে গত বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় স্টেশন ম্যানেজারের কক্ষে ছিল সাধারণ যাত্রীদের ভিড়। সবারই চাওয়া টিকিট। এত মানুষের অনুরোধে স্টেশন ম্যানেজার পড়ে যান বেকায়দায়। কখনো বাইরে যাচ্ছিলেন, কখনো ভেতরে ঢুকছিলেন, আবার কাউকে আশ্বস্তও করছিলেন তিনি। ওই সময় কক্ষের বাইরে এক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর তিন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষার্থী দিতে ২ মার্চ রাজশাহী যাওয়ার কথা। অনলাইনে বা কাউন্টারে কোথাও টিকিট পাননি। তাই স্টেশন ম্যানেজারের কাছে এসেছেন।
স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভদ্রলোক সকাল থেকে তিনবার এসেছেন; কিন্তু টিকিট আমার কাছেও নেই। তাঁকে ২ তারিখে আসতে বলেছি। যদি অতিরিক্ত বগির ব্যবস্থা হয়, তাহলে হয়তো টিকিট পেতে পারেন।’ ম্যানেজার জানান, বিশেষ অঞ্চলের অনলাইনে টিকিট এক ঘণ্টারও কম সময়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এতে অনেকেই তাঁকে অনুরোধ করেন টিকিটের ব্যবস্থা করে দিতে।
ট্রেনের টিকিট অনলাইনে ছাড়ার পর থেকে কমলাপুর রেলস্টেশনে অধিকাংশ কাউন্টার বন্ধ থাকছে। বুধবার স্টেশনে দেখা যায়, ২০টি কাউন্টারের মধ্যে মাত্র তিনটি চালু রয়েছে।
সম্প্রতি কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনে তিন দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও টিকিট পাননি তারেকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘সকাল ৮টায় অনলাইনে ছাড়ার পর মুহূর্তের মধ্যেই কক্সবাজার এক্সপ্রেসের ৩৯৫টি টিকিট হাওয়া হয়ে যায়। স্থানীয় অনেক বাসিন্দার অভিযোগ, অনলাইনে বা কাউন্টারে টিকিট না মিললেও রেলস্টেশনের আশপাশে কিছুক্ষণ ঘুরলেই ২০০-৩০০ টাকা বাড়তি দিয়ে টিকিট মিলছে।
রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিমও সম্প্রতি বলেছেন, টিকিট কালোবাজারি আছে। ট্রেনের টিকিট জালও করা হচ্ছে। এই চক্রটি সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ঢাকা-কক্সবাজার রুটে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় কিছুদিন আগে র্যাবের অভিযানে টিকিট কালোবাজারি চক্রের একাধিক সদস্য ধরা পড়ায় এখন তাদের তৎপরতা চোখে পড়ে না। তবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে তারা সক্রিয়। কালোবাজারি ছাড়াও কিছু টিকিট পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। এসব কারণে অনলাইনে পর্যাপ্ত টিকিট পান না যাত্রীরা। এ ছাড়া নিয়োগ পরীক্ষা, ঈদসহ বিশেষ দিনের টিকিটের চাহিদা বেশি থাকায় রেলওয়ের একটি সিন্ডিকেট টিকিট ধরে রাখে। এই চক্রে রয়েছেন সহজডটকমের কিছু কর্মকর্তাও। ঢাকায় নিয়োগ পরীক্ষা থাকলে চট্টগ্রামে আগের দিনের টিকিটের চাহিদা বেশি থাকে। তখন সহজডটকমের কম্পিউটার অপারেটর কিছুসংখ্যক টিকিট অনলাইনে দিয়ে বাকিগুলো আটকে রাখেন। তারপর সেগুলো কালোবাজারিতে বেশি দামে বিক্রি করা হয়।
অনলাইনে টিকিট বিক্রির ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বেনাপোল অঞ্চলের ট্রেনের আগামী ১০ দিনের টিকিট নেই। কক্সবাজার ও পর্যটক এক্সপ্রেসের টিকিট ৮ মার্চ পর্যন্ত অনলাইনে বা কাউন্টারে নেই। ৯ মার্চের টিকিট ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালে অনলাইনে আসার পর দুপুর ১২টা পর্যন্ত শখানেক আসন ফাঁকা দেখা যায়। রাজশাহীর ধূমকেতু, বনলতা, সিল্কসিটি, মধুমিতা, পদ্মা এক্সপ্রেসের ৬ মার্চ পর্যন্ত টিকিট অনলাইনে বা কাউন্টারে নেই। এসব অঞ্চলের টিকিট অনলাইনে আসার পর দ্রুতই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, গত বছর কক্সবাজার এক্সপ্রেস চালু হওয়ার পর তার টিকিট ২৩ নভেম্বর ছাড়া হয় অনলাইনে। এই ট্রেনের সব টিকিট শেষ হয়ে যায় ১০ মিনিটেই। দুই ঈদের সময় অগ্রিম টিকিট আধা ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।
সূত্রমতে, অগ্রিম টিকিট নির্দিষ্ট দিন সকাল ৮টায় দেওয়া হয় ‘রেলসেবা’ অ্যাপে। কালোবাজারিরা আগে থেকেই অনলাইনে ওত পেতে থাকে। পরে বিভিন্ন মাধ্যমে সেই টিকিট তারা দ্বিগুণ বা তার চেয়েও বেশি দামে বিক্রি করে।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, বিশেষ দিনগুলোতে টিকিট কেটে রাখেন কিছু দোকানদার। পরে তাঁরা বাড়তি দামে বিক্রি করেন। তাই সাধারণ যাত্রীরা টিকিট কম পান। এ ছাড়া ৪ লাখ মানুষ ২০ হাজার টিকিটের জন্য ঢোকেন। তখন অনেকেই টিকিট না পেয়ে রেলওয়েকে দোষ দেন।
রেলওয়ের টিকিটিং পার্টনার সহজ ভিনসেন জেভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সন্দ্বীপ দেবনাথ বলেন, তাঁরা এখন নজরদারি বাড়িয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি কাউন্টার আইডি পাওয়া যায়, যেগুলো দিয়ে কালোবাজারি হতো। তিনি আরও বলেন, কেউ যদি কোনো টিকিট কিনতে চান তাহলে সেটার প্রক্রিয়া হতে একটু সময় লাগে। যদি টিকিট না কিনে থাকেন, তবে সেটি আবার অনলাইনে দেখায়। অনেকেই এ সময়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন না।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন জমির উদ্দিন (চট্টগ্রাম) ও মাইনউদ্দিন শাহেদ (কক্সবাজার)]