হোম > ছাপা সংস্করণ

আহা! কাবাব!

জাহীদ রেজা নূর

যে যা-ই বলুক, স্বীকার করুক আর না-ই করুক, রসনার সঙ্গে কাবাবের একটা যোগাযোগ আছে। প্রাচীনকালের জিহ্বাও কাবাবের অসাধারণত্ব স্বীকার করে নেয়। আজ বিশ্ব কাবাব দিবসে কাবাব নিয়ে কিছু কথা হোক।

কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, মানুষ যখন আগুনের ব্যবহার শিখল, তখন থেকেই তো শিকার করা বন্য প্রাণী ঝলসে নিতে শুরু করল।সেটাই হচ্ছে কাবাব। হ্যাঁ, ঝলসানো মাংসকে যদি কাবাব বলা হয়, তাহলে এ তথ্য মেনে নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু সুস্বাদু খাবার হিসেবে আমাদের টেবিলে এখন যা আসে, তা আসলে উঁচু দরের সংস্কৃতিবোধেরই প্রকাশ।

কোন কোন মসলা দিয়ে ম্যারিনেট করে রেখে কতক্ষণ কয়লার আগুনের ওপর ঝলসে নিয়ে রসাল কাবাবটি তৈরি হবে, তা বহু শেফের মাথা ঘুরে একটা রূপ পেয়েছে। একটা রূপ বলছি কেন, অনেকগুলো রূপ পেয়েছে। তাই পৃথিবীর নানা প্রান্তে এখন লোভনীয় খাবারের তালিকায় কাবাব অগ্রগণ্য। বলতে চাইছি, ঝলসানো মাংস মাত্রেই কাবাব নয়। কাবাব তৈরি করা মেহনতের ব্যাপার এবং সেটা সুস্বাদু করাটাও গবেষণার ব্যাপার। এ কারণেই আজকাল ঢাকা মহানগরের যত্রতত্র গড়ে ওঠা কাবাবের অধিকাংশ দোকানে গেলে বোঝা যায়, কোথায় যেন একটা ‘কিন্তু’ আছে। যা চেয়েছি, তা যেন ঠিক পাচ্ছি না।

চিকেন টিক্কা কিংবা শিক কাবাব নামে যা চালিয়ে দেওয়া হয়, তার অনেক কিছুই আমার প্রাচীন মুখে রোচে না। বুঝতে পারি, সেই সত্তরের দশকের শুরুতে এখনকার কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ে (এয়ারপোর্ট রোড) অবস্থিত দারুল কাবাবে যে কাবাবের আস্বাদ পেয়েছি, তা আর ফিরে আসবে না। কিংবা মগবাজারের ক্যাফে ডি তাজের সুস্বাদু কাবাবগুলোর কথা কি ভোলা যায়? নতুন ঢাকায় আমার বেড়ে ওঠা, তাই পুরান ঢাকার কাবাবের কথা বললাম না। কিন্তু বাংলাদেশে কাবাবের মূল রাজধানী হলো পুরান ঢাকা, সে কথা তো হরহামেশা শুনে এসেছি। নানা ধরনের বিরিয়ানি আর কাবাব ছাড়া কি পুরান ঢাকাকে চেনা যায়?

ঢাকা শহরের কাবাব নিয়ে হেকিম হাবিবুর রহমান যা বলে গেছেন, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক। ঢাকার প্রসিদ্ধ কাবাব হিসেবে তিনি যে ‘পারসন্দের’ শিক কাবাবের কথা বলেছেন, সেটা এখন বুঝি শুধু কল্পনাতেই পাওয়া যায়। ১০-১৫ সের ওজনের এই শিক কাবাবের মাংস সেদ্ধ হয়ে যাবে, শুকনো থাকবে, প্যাচপেচে হবে না, কাবাব ভাঙার সময়ই তা চুরচুর হয়ে যাবে।

হেকিম সাহেব তো শিক কাবাবের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন রুই, শোল আর চিংড়ি মাছের কাবাবের কথা। মোরগ মুসল্লমকেও তো কাবাব হিসেবে ধরতে হবে। এই খাদ্য তৈরি করার জন্য বিশেষ বা স্পেশাল বাবুর্চি থাকে, যে কারও হাতে এই কাবাব হবে না।

আমরা কয়লায় ঝলসানো মাংসকেই কাবাব বলি। কিন্তু এখন আমাদের অভিজ্ঞতায় রয়েছে এমন সব কাবাব, যা ঝলসানো হয় না, তেলে ভাজা হয়। এ রকম কাবাবের মধ্যে জালি কাবাব, শামি কাবাব, বিফ চাপ, মাটন চাপ ইত্যাদি রয়েছে। তবে আগুনে ঝলসানো চিকেন টিক্কা, শিক কাবাবের পাশাপাশি হরিয়ালি কাবাব, রেশমি কাবাবের নামও তো করতে হয়। তবে এত ধরনের কাবাব রয়েছে যে নামের তালিকা করলে এই পরিসরে কিছু লেখা যাবে না, তাই এ আলোচনায় ক্ষান্ত দিই।

খাবার নিয়ে কথা বলতে গেলে ঘুরে-ফিরে সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছেই ফিরতে হয়। তাঁর রসাল বর্ণনায় কত ধরনের খাদ্যের কথা যে কতবার উঠে এসেছে, তার ইয়ত্তা নেই। ইলিশ যদিও কাবাব নয়, কিন্তু ইলিশের ব্যাপারে, বিশেষ করে সরষে ইলিশের ব্যাপারে তাঁর পক্ষপাতিত্বের কথা সবারই জানা। ইলিশ সম্পর্কে পঞ্চতন্ত্রের ‘আড্ডা’য় লিখেছেন, ‘বেহেশতের বর্ণনাতে ইলিশের উল্লেখ নেই বলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে সেথায় যাবার ইচ্ছা, কণামাত্র বাসনা আমার নেই।’

কাবাব সম্পর্কে অন্তত দুটি উদ্ধৃতি তাঁর কাছ থেকে নিতে চাই। পঞ্চতন্ত্রের ‘আহারাদি’ প্রবন্ধে তিনি অন্য অনেক জায়গার খাবারের বর্ণনা দিতে দিতে বলছেন, ‘কাইরোতে খেলেন মিশরী রান্না। চাক্তি চাক্তি মাংস খেতে দিল; মধ্যিখানে ছ্যাঁদা।...খাচ্ছেন আর ভাবছেন, বস্তুটা কী, কিন্তু কোনো হদিস পাচ্ছেন না। হঠাৎ মনে পড়ে যাবে, খেয়েছি বটে আমজাদিয়ায় এইরকম ধারা জিনিস—শিক কাবাব তার নাম। তবে মসলা দেবার বেলায় কুঞ্জুসি করেছে বলে ঠিক শিক কাবাবের সুখটা পেলেন না।’

এটা একটা ভালো পর্যবেক্ষণ। এই পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যাটাও তাঁর ভাষায়, ‘পৃথিবীতে কুল্লে দুই রকম রান্না হয়—মসলাযুক্ত ও মসলাবর্জিত।মসলা জন্মে মূলত ভারতবর্ষে, জাভায়, মালয়ে। ইউরোপে মসলা হয় না। তাই ইউরোপের রান্না সাধারণত মসলাবর্জিত।...তুর্ক পাঠানরা যখন এ দেশে আসে, তখন পশ্চিম ও উত্তর ভারত নিরামিষ খেত। তুর্ক-পাঠানরা মাংস খেত বটে, কিন্তু সে রান্নায় মসলা থাকত না। তুর্ক-পাঠান-মোগলরা যে রকম ভারতবর্ষের অলংকার কারুকার্যের সঙ্গে তুর্কিস্থানি স্থাপত্য মিলিয়ে তাজমহল বানাল, ঠিক সেই রকম ভারতীয় মসলার সঙ্গে তাদের মাংস রান্নার কায়দা মিলিয়ে এক অপূর্ব রান্নার সৃষ্টি করল।’

সেই প্রাচীনকালে আদিম মানুষেরা শিকার করা পশু বা পাখির মাংস আগুনে ঝলসে নিক আর না নিক, পৃথিবীতে কাবাবকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে ‘তুর্কির তেজ তলোয়ার’-এর অবদান থাকুক না থাকুক, আমরা আসলে এখন এই বাংলাদেশে বসে যে কাবাব খাই, তাতে ঐতিহ্যের ছোঁয়া যেমন আছে, তেমনি নিজেদের নানা মসলার মিশ্রণের ভালোবাসাও রয়েছে। তাই দেশের বাইরে যখন একই নামের কাবাব খাওয়া হয়, তখন একই স্বাদ পাওয়া যায় না।

তারপরও মানুষের পছন্দের তালিকায় কাবাব কেন থাকে, কেন কাবাব সারা বিশ্বেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, তা নিয়ে ভাবুন বিশ্ব কাবাব দিবসে।

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ