হোম > ছাপা সংস্করণ

দেবর-ভাবির দ্বন্দ্বে সংকটে জাপা

মহিউদ্দিন খান মোহন

সমাজে দেবর-ভাবির সম্পর্ক বেশ মিষ্টি-মধুর। ভাবিরা দেবরকে ছোট ভাই-জ্ঞানে আদর-স্নেহ করেন। আর দেবরেরা ভাবিদের মাতৃতুল্য মনে করে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। ভাবি যেমন তাঁর কষ্টের কথা দেবরের কাছে প্রকাশ করেন, তেমনি দেবরও তার চাওয়া-পাওয়ার অনেক আবদার বড় ভাইকে বলার সাহস না পেলেও ভাবির কাছে অকপটে বলে থাকে। দেবর-ভাবির মিষ্টি-মধুর সম্পর্কের কাহিনি নিয়ে আমাদের দেশে অনেক গল্প-সিনেমা-নাটকও রয়েছে। শুধু আমাদের দেশ কেন, প্রতিবেশী ভারতে বাংলা ও হিন্দি সিনেমায় এমন গল্পের অভাব নেই। তবে দেবর-ভাবির পবিত্র সম্পর্কের মধ্যেও অনেক সময় অনৈতিকতা ঢুকে পড়ে। আবার কখনো কখনো হিংসা, বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা কিংবা সম্পত্তিগত বিরোধের কারণে দেবর-ভাবির সম্পর্ক সাপে-নেউলে হয়ে ওঠার দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই।

এ মুহূর্তে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে দেবর-ভাবির সম্পর্ক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে সেই সম্পর্ক মিষ্টি-মধুর নয়, তেতো। জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে দেবর-ভাবি দ্বন্দ্বের বিষয়টি এখন আর অপ্রকাশ্য নেই। এ দ্বন্দ্ব বেশ পুরোনো। দলটির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকাকালেই এর অঙ্কুরোদগম হয়েছিল। অসুস্থ এরশাদের হয়েছিল ‘শ্যাম রাখি, না কুল রাখি’ অবস্থা। একদিকে আদরের ছোট ভাই, অন্যদিকে প্রিয়তমা স্ত্রী।

কাকে রাখবেন, কাকে ফেলবেন। শেষ পর্যন্ত দুজনকে কো-চেয়ারম্যান করে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন সে যাত্রায়। স্ত্রী রওশনকে করেছিলেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা আর ভাই জি এম কাদেরকে করেছিলেন উপনেতা। কিন্তু ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে এবং দলের ভাঙন প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। নানা রকম একাঙ্কিকা ও নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার পর দৃশ্যত দলীয় নেতাদের মধ্যস্থতায় দ্বন্দ্বের অবসান হয়; যদিও অনেকেই মন করেন এর পেছনে বর্তমান জাতীয় পার্টির ‘লিগ্যাল গার্জেন’ ক্ষমতাসীন সরকারের প্রভাবক কাজ করেছে। সমঝোতা অনুযায়ী জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যান এবং রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা ও দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হন। সেভাবেই চলে আসছিল এত দিন। এরই মধ্যে রওশন এরশাদ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য যান থাইল্যান্ডে। সেখানে হাসপাতালের বেডে শুয়েই তিনি জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু গোল বাধে রওশন এরশাদের একটি চিঠিতে। হঠাৎ করেই গত ৩১ আগস্ট তিনি চিঠি দিয়ে নিজেকে আহ্বায়ক এবং নিজের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহকে সদস্যসচিব করে জাতীয় পার্টির সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি ঘোষণা করে দলের কাউন্সিল অধিবেশন ডাকেন ২৬ নভেম্বর। তাঁর এই ঘোষণা দলের মধ্যে স্তূপকৃত বারুদে যেন দেশলাই ছুড়ে মারে। দলের পক্ষ থেকে ওই চিঠি প্রত্যাহারের জন্য রওশনকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি তা আমলে না নেওয়ায় জাপার পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠকে রওশনকে অব্যাহতি দিয়ে জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত করা হয়। সেই সিদ্ধান্তের কথা যথারীতি চিঠি দিয়ে অবহিত করা হয় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে। কিন্তু দুই মাস অতিক্রান্ত হলেও স্পিকারের কাছ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সংসদের চলতি অধিবেশন শুরুর আগে গত ৩০ অক্টোবর জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর নেতৃত্বে কয়েকজন এমপি স্পিকারের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা জি এম কাদেরকে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশের দাবি জানান। কিন্তু স্পিকার তা করেননি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জাপার সংসদীয় দলের বৈঠকে জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ না করা পর্যন্ত সংসদ বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় (আজকের পত্রিকা, ৩১ অক্টোবর, ২০২২)।

জি এম কাদেরের এই অনমনীয় মনোভাব রওশন শিবিরে ভীতির সৃষ্টি করে। ১ নভেম্বর আজকের পত্রিকার ‘কাদেরের কঠোরতায় নড়বড়ে রওশন দুর্গ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রওশন অনুসারীরা কাউন্সিলের যে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, জি এম কাদেরের শক্ত পদক্ষেপে তাঁদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।

উল্টো এখন রওশন এরশাদ সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদ হারাতে বসেছেন। রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, কাদের গ্রুপের সংসদ বর্জনের হুমকি ক্ষমতাসীনদেরও চিন্তিত করে তোলে। একদিকে মাঠে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শক্তির মহড়া যথেষ্ট চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে সহযোগী-সহযাত্রী জাতীয় পার্টিও যদি দূরে সরে যায়, তাহলে সরকার অনেকটা একা হয়ে পড়বে। আর সে জন্যই জাতীয় পার্টির রাজনীতির অভ্যন্তরে জ্বলে ওঠা কলহের আগুন ছাইচাপা দিতে তৎপর হয় সরকার। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে হঠাৎ করেই রওশন এরশাদ আহূত কাউন্সিল স্থগিত করা এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জি এম কাদেরদের সংসদে ফেরার ঘোষণায়।

এ বিষয়ে একই দিনে অপর একটি দৈনিকে প্রকাশিত ‘জাপায় সরকারের মধ্যস্থতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সরকার এ মুহূর্তে বিরোধীদলীয় নেতার পদে পরিবর্তন চায় না’—স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী জাপার নেতাদের এই আভাস দেওয়ার পরই জাতীয় পার্টি সংসদ বর্জনের ঘোষণা দেয়। জাপার সংসদীয় দলের এ সিদ্ধান্তের আধা ঘণ্টার মধ্যে রওশন এরশাদ আহূত কাউন্সিল অধিবেশন স্থগিত করেন। পত্রিকাটি লিখেছে, রওশনের ঘনিষ্ঠ একজন নেতা জানিয়েছেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় কাউন্সিল স্থগিত করা হয়েছে। রওশন-আহূত কাউন্সিল অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা আসার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জি এম কাদের গ্রুপও তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে সংসদে ফেরার ঘোষণা দেয়। এভাবেই জাতীয় পার্টিতে জ্বলে ওঠা আগুন আপাতত নির্বাপিত হয়েছে। 
অপরদিকে জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব গড়িয়েছে আদালতে। একসময়ের মহাসচিব ও সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সব পদ-পদবি থেকে এবং দলটির উপদেষ্টা জিয়াউল হক মৃধাকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়ে পৃথক দুটি নালিশি মামলা হয় ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে। ওই মামলার প্রথম শুনানি শেষে আদালত নির্দেশনা জারি করেন, ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর অনুমোদিত গঠনতন্ত্রের আলোকে এ সময় (মামলা চলাকালীন) জি এম কাদের কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন না। এ অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা-আদেশের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন জি এম কাদের। ৬ নভেম্বর ঢাকার প্রথম যুগ্ম জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক কাজী মুশফিক মাহবুব রবিনের আদালতে তিনি তাঁর ওপর আরোপিত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বাতিল অথবা প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেছেন।

কোনো রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে আদালতে মামলার নজির কম। প্রথা মোতাবেক রাজনৈতিক দলের সমস্যা দলের অভ্যন্তরে আলোচনার মাধমে সমাধান হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে আদালতকে জড়ানো অপরিণামদর্শী চিন্তাভাবনারই বহিঃপ্রকাশ। এভাবে যদি রাজনৈতিক ইস্যুতে আদালতে মামলা হতে থাকে এবং আদালত তাঁর বিজ্ঞ বিবেচনায় নির্দেশনা দিতে থাকেন, তাহলে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটতে পারে। এমনটি চলতে থাকলে যে কেউ দলের কোনো সিদ্ধান্ত মনঃপূত না হলে আদালতে মামলা ঠুকে দিলে দলটির কার্যক্রমে মারাত্মক বিঘ্নের সৃষ্টি হতে পারে। তা ছাড়া, কোনো রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ অনাকাঙ্ক্ষিতও বটে।

বর্তমানে জাতীয় পার্টি যে সরকারের পথনির্দেশ অনুসরণ করেই হাঁটে, সেটা সর্বজনবিদিত। দলটির স্বকীয়তা বলে কিছু নেই। ২০০৯ সাল থেকে তারা সরকারের ছায়াসঙ্গী। আওয়ামী লীগ যেভাবে বলে জাপাও সেভাবেই কর্ম করে। একসময় ছিল সরকারের পার্টনার, এখন অনুগত বিরোধী দল। রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল বলছে, এখনো জাতীয় পার্টি মঞ্চের সামনে শোলার পুতুল; এর সুতো রয়েছে পর্দার পেছনে সরকারের হাতে। সেই সুতোর টানে রওশন কাউন্সিল ডাকেন আবার স্থগিত করেন। আর জি এম কাদের সংসদ বর্জনের ঘোষণা দিয়েও ২৪ ঘণ্টা পেরোনোর আগেই ফিরে আসেন। সমালোচকেরা বলছেন, এ মুহূর্তে ওই সুতোর টানের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা দেবর-ভাবি কারোরই নেই।

১৯৮৪ সালে জন্ম নেওয়া ৩৮ বছর বয়সী জাতীয় পার্টি অনেক সমস্যা-সংকটে পড়েছে। ভেঙেছেও কয়েকবার। তবে এবার দেবর-ভাবির দ্বন্দ্বে সৃষ্ট সংকট থেকে দলটি বেরিয়ে আসতে পারে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ