পাকিস্তান সরকার বাংলা সংস্কৃতির পরোক্ষ বিরোধিতা করেছিল, এ কথা নতুন কিছু নয়। সবার অলক্ষ্যে সংস্কৃতিবিরোধী কিছু করার মানসিকতা ছিল তাদের। জয়নুল আবেদিন তাদের সেই ষড়যন্ত্রের জবাব দিয়েছিলেন পরোক্ষভাবে। পরোক্ষ বদমায়েশীর পরোক্ষ বিরোধিতা।
আর্ট কলেজের যে বার্ষিক প্রদর্শনীটি হয়েছিল, একবার তাতে তিনি তোরণ নির্মাণ করেছিলেন গ্রামীণ আটচালা ঘরের আদলে। তাতে ছিল নকশি করা ভেলকি। খাবার-দাবারের ব্যাপারেও লোকজরীতি মেনেছেন। খাইয়েছেন নকশি পিঠা। অতিথিদের শুনিয়েছেন লোকসংগীত। বাঙালি সংস্কৃতি যে এ দেশের মাটি থেকে উদ্ভূত, মাটির গভীরেই এর শিকড় প্রোথিত, উপস্থিত সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছেন সে কথা।
লোকজশিল্পের প্রতি জয়নুল আবেদিনের যে অসাধারণ ভালোবাসা ছিল, তার প্রমাণ দেওয়ার দরকার নেই। তবু যদি কারও মনে ঔৎসুক্য থাকে, তবে তিনি তাঁর শান্তিনগরের বাড়িতে যেতে পারতেন। যে বাড়িটায় থাকতেন জয়নুল আবেদিন, সেই বাড়ির এক আলমারি ভর্তি ছিল মাটির পুতুল, শখের হাঁড়ি, লক্ষ্মীর সরা, নকশিকাঁথা। শিক্ষার্থীদের বলতেন, ‘লোকশিল্প সংগ্রহ করো।’ তখনকার আর্ট স্কুলের গোল গ্যালারির বাইরের দিকে লোকশিল্প সংগ্রহের একটি সেলস সেন্টারও করেছিলেন জয়নুল।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সেখানে নানা ধরনের পণ্য আসত। কোনো বিদেশি অতিথি এলে সেখান থেকে তাঁদের উপহার দেওয়া হতো। সেই উপহার পেয়ে তাঁরা বিস্মিত হতেন, আনন্দিত হতেন। এটা ছিল আমাদের লোকজ ঐতিহ্যের প্রতি দৃষ্টি ফেরানোর জন্য জয়নুল আবেদিনের একটি কৌশল।
শুধু ছবি আঁকা শিখলেই সার্থক শিল্পী তৈরি হয় না, এটা তিনি বুঝতেন। তাই আর্ট স্কুলের চৌহদ্দিতে কবি-সাহিত্যিক-গাইয়ে-বাজিয়ে এবং অভিনেতাদের আনাগোনা ছিল বিস্তর। যেকোনো অনুষ্ঠানে তাঁদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পাওয়ায় ছাত্রাবস্থাতেই শিল্পীরা এমন অনেক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেতেন, যা তাঁদের ভবিষ্যৎ জীবনের দিকদর্শন হিসেবে কাজ করত।
সূত্র: কাইয়ুম চৌধুরী, জীবনে আমার যত আনন্দ, ৪৭-৪৮