আজকের পত্রিকা: সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক হয়েছেন। আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে অভিনন্দন। আপনার অনুভূতি কী?
নজরুল ইসলাম: ধন্যবাদ। অনুভূতিটা অবশ্যই আনন্দের। আমি খুবই খুশি হয়েছি। কারণ আমি সারা জীবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। সরাসরি এখানে শিক্ষকতা পেশায় ছিলাম ২০০৭ সাল পর্যন্ত।
আজকের পত্রিকা: পরিকল্পিত নগরায়ণ করার ক্ষেত্রে আমাদের কী কী করা উচিত?
নজরুল ইসলাম: এই প্রশ্নটায় একাধিক মাত্রা আছে। প্রথমত, সারা দেশের নগর ভাবনা। দ্বিতীয়ত, একটি নির্দিষ্ট শহরের পরিকল্পনা এবং তৃতীয়ত, শহরবিশেষের পরিকল্পনা। সেটা ঢাকা বা অন্য কোনো জেলা কিংবা উপজেলা শহর হতে পারে। এ রকম ভাবনা নিয়ে নগর উন্নয়নের পরিকল্পনা করতে হবে।
বাংলাদেশ কৃষি ও গ্রামপ্রধান দেশ। গত ৫২ বছরে গ্রামের বিশাল পরিবর্তন হয়েছে। প্রতিনিয়ত গ্রাম থেকে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। ৭০ বা ৫০ বছর আগে ৯০ শতাংশ লোক গ্রামে থাকত। এখন ৩৫ শতাংশ শহরে আর বাকি ৬৫ শতাংশ গ্রামে থাকে। এই যে বিশাল পরিবর্তন হয়েছে ঢাকাসহ আরও কিছু বড় শহরে, তা তো এক দিনে ঘটেনি।
আমাদের দেশে শহরের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। বিভাগীয় শহরগুলোতে ৫ লাখের বেশি লোক বাস করে। ১ কোটির বেশি হলে তাকে মেট্রোপলিটন শহর বলে। যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম। বড়, মাঝারি ও ছোট শহরের শ্রেণিক্রম অনুযায়ী পরিকল্পনাসহ রূপকল্প প্রণয়ন করতে হবে। আগে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রূপকল্প করা হতো না। যেমন—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আজি হতে শত বর্ষ পরে…’ কথাটি বলেছিলেন। শত বর্ষ পরে কী হবে? এখন রাজউক ঢাকার নগর পরিকল্পনা ২০ সাল মেয়াদি করে থাকে। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি, আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে নগর পরিকল্পনা করতে হবে। আর রূপকল্পের সঙ্গে উন্নয়ন দর্শনও থাকতে হবে পরিকল্পনার মধ্যে।
পরিবেশসম্মত ও বৈষম্যহীন শহর গড়ে তুলতে হবে। আর দর্শনের ক্ষেত্রে মানবিক শহরের ধারণাটা মাথায় রাখতে হবে। যারা এখানে থাকবে, সবার জন্য যেন এটা বসবাসযোগ্য হয়ে ওঠে; যেখানে ধনী, গরিব, মধ্যবিত্তের বিভাজন থাকবে না। এর জন্য সব ধরনের ব্যবস্থাপনা যেমন—আবাসন, পরিবহন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও বিনোদনের ব্যবস্থা পরিকল্পনার মধ্যে রাখতে হবে। মূল কথা হলো, পরিকল্পিত শহর গড়ে তোলার জন্য দৃষ্টিভঙ্গি, আদর্শ ও রাষ্ট্রীয় চিন্তাকাঠামোর ওপর জোর দিতে হবে।
আজকের পত্রিকা: ঢাকাকে আমরা কীভাবে বায়ুদূষণ থেকে মুক্ত করতে পারি?
নজরুল ইসলাম: ঢাকার মূল সমস্যা বায়ুদূষণ। তবে এর সঙ্গে পানি, শব্দদূষণও আছে। এসব দূষণের মূল কারণ হচ্ছে শিল্পকারখানা। পোশাকশিল্পে বায়ুদূষণ সেভাবে হয় না। তবে এর ডাইংয়ের মাধ্যমে পানিদূষণ হয়। বায়ুদূষণটা হয় মূলত পরিবহনের মাধ্যমে। আর বেশি করে উচ্চবিত্ত সমাজের লোকেরা। আগে বেশির ভাগ গাড়ি চলত তেলে, পরে গ্যাসে চলা শুরু হলো। ভয়াবহ ব্যাপার হলো, অধিকাংশ প্রাইভেট গাড়িতে এসি থাকে। আর ভবনগুলোতেও এসি থাকে। এটাতে বেশি পরিবেশদূষণ হয়ে থাকে। এসির কারণে শহরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়।
গাছ কাটলেও বায়ুদূষণ ঘটে। শহরে যত গাছ থাকবে, তত ভালো। বাংলাদেশ আর্দ্রক্রান্তীয় জলবায়ু এলাকা। বৃষ্টিবহুল ও উচ্চ তাপমাত্রা এখানে বিরাজ করে। ফলে এখানে গাছপালা সহজে হয়, যেটা মরু এলাকায় হয় না। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ গাছ থাকার কথা, তার চেয়ে তুলনামূলক কম আছে। কারণ পুরোনো গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, সে তুলনায় নতুন গাছ লাগানো হচ্ছে না।
মূল কথা হলো, ঢাকা শহরের দূষণের মাত্রা কমানোর জন্য পরিবহনের দূষণের মাত্রা কমাতে হবে। গাছপালা, বিশেষ করে বড় গাছ বেশি করে রাখতে হবে। শিল্পকারখানার দূষণ কমাতে হবে। ইটভাটার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। দূষণের এসব সূত্র খেয়াল করা এবং এগুলো কীভাবে দূষণ করে, তা নিয়ন্ত্রণে কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে। এসব কাজ তদারকির দায়িত্ব মূলত রাজউক, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের। এর বাইরে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান আছে। সবাইকে নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান করা উচিত।
আজকের পত্রিকা: স্বাধীনতার ৫২ বছরে শিক্ষার অনেক প্রসার ঘটেছে। কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষায় পিছিয়ে আছি। এটার জন্য কী করা উচিত?
নজরুল ইসলাম: বাংলাদেশে শিক্ষায় ব্যাপক প্রসার হয়েছে। সংখ্যায় সেটা প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিস্তার ঘটেছে। দেশটা তো ছোট, কিন্তু বিশাল জনসংখ্যা। স্বাধীনতার সময় সাক্ষরতার হার ২০ শতাংশ আর এখন সেটা ৭০-৭৫ শতাংশ। হওয়া উচিত ছিল ১০০ শতাংশ, কিন্তু সামনের দিকে এগোচ্ছে। এর জন্য আরও স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এর সঙ্গে শিক্ষক ও অবকাঠামো দরকার। কথা হলো, সংখ্যা বাড়লে গুণগত মান নিশ্চিত হবে না। কথাটি সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাই মান প্রতিষ্ঠার জন্য সময়, অর্থ ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা লাগবে। দ্রুততার সঙ্গে শিক্ষকের সংখ্যা বাড়াতে গেলে মান ধরে রাখা যাবে কি না, সেটা গুরুতর প্রশ্ন।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কী হয়েছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ধরা যাক। এর বয়স তো ১০০ বছর পেরিয়ে গেছে। সবাই বলেন, এর পড়াশোনার মান কমেছে। আর এই কমা-বাড়ার হিসাবেও গরমিল আছে। একসময় এখানে সর্বোচ্চ ৫০০ জন শিক্ষক ছিলেন। এখন শিক্ষকের সংখ্যা দুই থেকে আড়াই হাজার। প্রভাষক থেকে অধ্যাপক হওয়ার জন্য নির্ধারিত মান অর্জন করতে হয়। বর্তমানে একজনের পিএইচডি থাকলে ১২ বছরেই অধ্যাপক হয়ে যান। আগে অধ্যাপক হওয়ার জন্য ২৫ থেকে ৪০ বছর অপেক্ষা করতে হতো। এখন কোয়ালিফাইড হলেই তিনি অধ্যাপক হয়ে যান। এখন এ রকম শিক্ষকের চাহিদা।
শিক্ষক নিয়োগের চাহিদা পূরণ করতে হলে মান ধরে রাখা কঠিন। এর জন্য সময় একটা ব্যাপার। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ জাতীয়ভিত্তিক পরিকল্পনার বিষয়টি। শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা দরকার। এর জন্য যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। কিছু কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সেসবে গুরুত্ব দেয়, কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় সেটা করতে পারছে না। আবার কিছু কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নিজ উদ্যোগে সেসব করছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং তারা আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতিও পেয়েছে।
অনেকে বলেন এবং আমিও বলছি, সার্বিকভাবে উচ্চশিক্ষায় মান কমেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কমেছে না বেড়েছে, তার জন্য প্রতিটি বিষয় ধরে কথা বলতে হবে। গবেষণা, শিক্ষাদান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মান, প্রকাশনা—এসব ধরে ধরে মান যাচাই করে সমস্যা খুঁজে বের করতে হবে। যদি বুয়েটের কথা ধরি, এটা অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠান। তাদের গুণগত মান আছে কি না, তা কীভাবে নির্ধারিত হবে? আন্তর্জাতিকভাবে তাদের চাহিদা আছে কি না? এখনো ব্যাপক চাহিদা তাদের। এখানকার শিক্ষার্থীরা পাস করার পরেই চাকরি পেয়ে যায়। এমনকি উন্নত দেশে তাদের চাহিদা আছে। মান কমলে তো এ রকম হতো না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়েও অনেক সমস্যা আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কীভাবে অক্সফোর্ডের তুলনা হতে পারে? তাদের একটা বিভাগের যে বাজেট, সেটা আমাদের পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের সমান। আমাদের এখানকার শিক্ষকদের যে বেতন, তা দিয়ে সংসার খরচের পর একটি বিদেশি প্রকাশনার বই কেনা সম্ভব হয় না। তাই উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য বিশাল অঙ্কের টাকা বরাদ্দ দিতে হবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটি দেশের জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে হয়, আমাদের এখানে ব্যয় করা হয় মাত্র ২ শতাংশের নিচে। তাহলে কীভাবে শিক্ষার উন্নতি হবে?
আজকের পত্রিকা: সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু মানবিক মূল্যবোধ কমেছে। মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কী করণীয়?
নজরুল ইসলাম: গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রকৃত স্বাধীনতা পাওয়ার জন্যই তো মুক্তিযুদ্ধ করেছি। গণতন্ত্র ছিল না। পশ্চিম ও পূর্বের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল। ওরা খাবে আমরা খাব না, তা তো হবে না—এই কথা বঙ্গবন্ধুর ছিল। তার মানে, বৈষম্যহীন অর্থনীতি হবে। সেটার জন্য স্বপ্ন দেখানো হলো সমাজতান্ত্রিক দেশ হবে। ওই চিন্তায় ফিরে যেতে পারলে ভালো। আগে ছিল সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী। এখন তো পুরোপুরি পুঁজিতান্ত্রিক। পুঁজিপতিদের হাতেই দেশের নিয়ন্ত্রণ। আগে তারা অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ করত আর এখন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও করে। তারা সংসদে গিয়ে মন্ত্রী হয়।
এখন অর্থনৈতিক বৈষম্যহীনতা বা সাম্যের চিন্তা—এই মূল্যবোধটা আনতে হবে আগে। আর একটা হলো, গণতান্ত্রিক রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে হবে। এখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা যেভাবে থাকার কথা, সেটা নেই বলে অনেকে মনে করছেন।
একাত্তরের পর থেকেই জাতি ভীষণভাবে বিভাজিত। যেমন—ধর্মীয়ভাবে বিভাজন বেড়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তো একটা নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে। পাঁচ শতাধিক ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। এটাতে কী হবে আমি জানি না। কিন্তু সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। আবার মডেল মসজিদ করা হচ্ছে। কথা হলো, মডেলের মানেটা কী? এখানে তারা কি উদার, না গোঁড়া হবে?
সারা দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ সংকটের মধ্যে আছে। শুধু নির্বাচন নিয়ে কথা বললে হবে না।এখানে আবার নানা ধরনের স্বার্থ আছে। একদল লোক শুধু চিৎকার করছে। বিদেশে তাদের নেটওয়ার্ক আছে। তাই দেশের জন্য চিন্তা করতে হলে এসব নিয়ে ভাবতে হবে। ব্যক্তিগত, সামাজিক, ধর্মীয় ও দলগতভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ, সহনশীল এবং একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব বজায় রাখতে হবে।
আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
নজরুল ইসলাম: আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে আজকের পত্রিকার পাঠকদেরও ধন্যবাদ।