হোম > ছাপা সংস্করণ

সমাজ সমাজের হাতে নেই, রাষ্ট্রের হাতেই

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আগের দিনের কথা বুকে হাত দিয়ে কী বলতে পারি যে তখন আমরা খুব ভালো ছিলাম? না, মোটেই না। ভালো তখনো ছিলাম না, এখনো নেই। তবে বুকভাঙা দুঃখ এখানে যে তখনকার খারাপ অবস্থাটা থেকে বের হয়ে আসার জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি, প্রাণ দিয়েছি, আমাদের মা-বোনেরা সম্ভ্রম হারিয়েছেন। হ্যাঁ, সংগ্রাম করে আমরা জয়ী হয়েছি। কিন্তু সর্বত্রই তো দেখতে পাই পরাজয়ের চিহ্ন। মনে হয় আমরা পরাজিত হয়ে গেছি। সেটা এই বিশেষ অর্থে যে উন্নতি আমাদের মুক্তি দেয়নি। উন্নতিটা মানবিক হয়নি, হয়েছে শত্রুভাবাপন্ন। এককথায় পুঁজিবাদী।

কুষ্টিয়ার ওই মানুষটার কথা ভাবা যাক। কাজী আনিসুর রহমান নাম। মধ্যবয়সী। সংস্কৃতিমনস্ক ছিলেন। কবিতা লিখতেন, ছাপাতেনও। ঢাকায় আসতেন, বইমেলাতে। আর্থিক অবস্থা নিতান্ত খারাপ ছিল না তাঁর। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্তও ছিলেন এবং নগদ এক কোটি টাকা বিনিয়োগও করেছিলেন, ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। কথা ছিল বন্ধু তাঁকে মাসে মাসে মুনাফা দেবেন। একেবারেই যে দেননি, তা-ও নয়। দিয়েছেন। বন্ধুর শিল্পপ্রতিষ্ঠান যে দেউলিয়া হয়ে গেছে, এমনও নয়। বন্ধুটি ভালো মুনাফা করেছেন, তাঁর সম্পত্তির বৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু হায়, কাজী আনিসুর রহমান শিকার হয়েছেন বঞ্চনার। মাসওয়ারি আয়টা বন্ধ হয়ে গেছে। আনিসুর রহমান এখন কী করবেন? কার কাছে বিচার চাইবেন? কে বিচার করবে? বন্ধুর কাছে তাঁর পাওনা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। টাকার হিসাব আছে, কিন্তু বন্ধুর দেখা নেই। রাজনৈতিক বন্ধুরা যে এগিয়ে আসবেন, তা-ও ঘটেনি। ওদিকে আনিসুর রহমান যে টাকাটা লগ্নি করেছিলেন, এর সবটা তাঁর নিজের ছিল না, আপনজনদের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। সেই আপনজনেরা এখন টাকা ফেরত চাইছেন। অসহায় আনিসুর রহমান ঘটনাটা জানাতে চেয়েছিলেন সমাজের কাছে।

ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এসেছেন। সংবাদ সম্মেলন করবেন? কীভাবে? কে দেবে সাড়া? অসহায় আনিসুর রহমান তাঁর ফরিয়াদটা জানানোর জন্য জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন নিজের গায়ে। বাঁচেননি। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। রূপকথা নয়, সত্য কথা। মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরের কথা। যুদ্ধাপরাধীর নয়; মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন মানুষের অগ্নিদগ্ধ প্রস্থানের কথা। অকল্পনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে।

আগের দিনের মানুষের মুখে একটি প্রবচন শোনা যেত, ‘ডালিম পাকিলে পরে আপনি ফেটে যায়, ছোটলোক বড় হলে বন্ধুকে ঠকায়।’ ছোটলোক বলতে তখন গরিব লোককেই বোঝাত। গরিব মানুষ মনের দিক দিয়েও দরিদ্র। নৈতিকতায় নিতান্ত খাটো। তক্কে তক্কে থাকে, অন্য কাউকে না পেলে নিজের বন্ধুকেই ঠকায়। এ রকমের ছিল ধারণা। ধারণাটা ভ্রান্ত ছিল, সন্দেহ কী। গরিব মানুষ হঠাৎ করে ধনী হয়ে যাবে, এটা এখন সম্ভব নয়, তখনো সম্ভব ছিল না। তবে হ্যাঁ, ঠকানোটা চলত। ঠকানো এখনো চলে, কিন্তু অধিকতর প্রশস্ত পথে। লুণ্ঠন নির্বিঘ্নে চলছে। ব্রিটিশ আমলে রেল কোম্পানি যাত্রীদের সতর্ক করে দেওয়ার জন্য ট্রেনের কামরায় লিখে রাখত, ‘সাবধান, চোর-জোচ্চোর আপনার নিকটেই আছে।’ তা ট্রেনের কামরার শুধু বদনাম কেন, চোর-জোচ্চোরের তৎপরতা এখন সর্বত্র এবং সমাজে তারাই সম্মানিত, যারা ওই সব তৎপরতায় দক্ষ। কে কাকে সাবধান করবে? আর এটাও তো সত্য যে ব্রিটিশ শাসকেরা নিজেরা ছ্যাঁচড়া চোর-ডাকাত ছিল না; ছিল অত্যন্ত উঁচুমাপের দস্যু ও তস্কর। তাদের কার্যাবলির কারণেই আমরা দরিদ্র হয়েছি এবং তাদের আচরিত আদর্শে দীক্ষিত হয়েই তো আমরা উন্নত হওয়ার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে চলেছি।

দিবারাত্রির ফারাক নেই। একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় যে সমাজ এখন আর সমাজের হাতে নেই, রাষ্ট্রের হাতে চলে গেছে। কথাটা যে অসত্য, তা নয়। রাষ্ট্রই তো প্রধান। রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা আছে; তার আছে বাহিনী, আছে তার আইন-আদালত। দিনকে রাত করে দিতে পারে, রাতকে দিন। কিন্তু একালে রাষ্ট্র ও সমাজকে বিচ্ছিন্ন করাটা কি আদৌ সম্ভব? না, সম্ভব নয়। ওই চেষ্টাটা আমরা ব্রিটিশ যুগে করতাম; আমাদের মনীষীরা আমাদের শেখাতেন যে রাষ্ট্র তো আসবে-যাবে, ভাঙবে-গড়বে, কিন্তু সমাজ রয়ে যাবে প্রবহমান। রাষ্ট্র বহিরাগতদের হতে পারে, সমাজ তো আমাদেরই। কিন্তু সমাজ যে রাষ্ট্রের অধীনে চলে যায়, অর্থাৎ বাধ্য হয় চলে যেতে, তার কী হবে? আর রাষ্ট্রের শাসকদের আদর্শই যে সমাজের ওপর নাজিল হয়ে থাকে, তারই বা প্রতিকার কী?

রাষ্ট্রকে বৈরী হিসেবে দেখাটা বেঠিক নয়; ঠিকই আছে, কিন্তু তাকে বদলানোর দায়টা কিন্তু সমাজেরই, অর্থাৎ সমাজের অগ্রসর মানুষদেরই। মুশকিল হলো, ওই অগ্রসর মানুষদের এখন খুঁজে পাওয়াটা ভার হয়েছে। পুঁজিবাদ তাদের চেনে, সম্ভাব্য শত্রু হিসেবে জানে এবং দমন করতে চায়। দমন করার কাজে রাষ্ট্রের বিশেষ রকমের অস্ত্র হচ্ছে দুটি—ভীতি ও প্রলোভন। রাষ্ট্র ভয় দেখায়, শাস্তি দেবে বলে জানায়, শাস্তি দিতে কসুরও করে না। এ ব্যাপারে সদাজাগ্রতই থাকে। রাষ্ট্র আবার প্রলোভনও দেখায়, পুরস্কার দেবে বলে। দেয়ও। অগ্রসর মানুষেরা নত হয়ে পড়ে—ভীতিতে এবং প্রলোভনে। ভীতি প্রদর্শন ও পুরস্কার প্রদানের জন্য আবশ্যক টাকাটা রাষ্ট্র কিন্তু নিজে উৎপাদন করে না, সেই ক্ষমতা তার নেই; টাকা আসে লুণ্ঠন থেকে। লুণ্ঠনের টাকা আবার জনগণের শ্রমে ও ঘামেই উৎপাদিত হয়। জনগণের অর্থ লুণ্ঠন করে ব্যবহার করা হয় জনগণকে তো বটেই, জনগণের পক্ষে বলার সম্ভাব্য শক্তিকেও দমনের জন্য। এমনটা আগেও ঘটেছে, এখনো ঘটছে। এখন অবশ্য এর তৎপরতাটা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাচ্ছে; রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এখন আগের চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। যেমন তার বিস্তার, তেমনি তার নিষ্ঠুরতা।

আব্রাহাম লিঙ্কন তাঁর গেটিসবার্গ বক্তৃতায় গণতন্ত্রের যে সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, সেটা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। সংজ্ঞা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে সংজ্ঞায়িত ওই গণতন্ত্র, অর্থাৎ জনগণের জন্য গঠিত, জনগণের দ্বারা পরিচালিত এবং জনগণের পক্ষের সরকার—পৃথিবী থেকে কখনো নিশ্চিহ্ন হবে না। সরকার ও রাষ্ট্রকে সেদিন তিনি পৃথক করেননি। সরকার এবং রাষ্ট্র যে এক নয়, এটা এখন সর্বদাই বলা হচ্ছে; কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে দিব্যি তারা এক হয়ে যায়; সরকারে যারা থাকে পারলে রাষ্ট্রকে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে ফেলে।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল সরকারকে নয়, রাষ্ট্রকেও জনগণের কর্তৃত্বাধীন করা চাই; কেননা, রাষ্ট্র সরকারের চেয়েও শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী প্রতিষ্ঠান। স্থূল সত্য বরং এটাই, রাষ্ট্রকেই গণতান্ত্রিক করা দরকার, তাহলে সরকারও বাধ্য হবে গণতান্ত্রিক হতে; কান ধরে টান দিলে মাথাও চলে আসবে। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সেই গণতন্ত্রীকরণটা কি সম্ভব? না, মোটেই সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের একেবারে প্রাথমিক শর্তটি হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা। ওদিকে পুঁজিবাদের প্রধান কাজই হলো মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়ানো। একের সন্ধ্যা আর অপরের সকাল; তারা মিলবে কী করে? মিলছে না।

তা যথার্থ গণতন্ত্র তো লিঙ্কনের নিজের দেশেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেখানকার ‘অগণতান্ত্রিক’ সহিংসতা এখন অনেক দেশকে লজ্জায় ফেলে দেয়। ৪ জুলাই আমেরিকায় স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে, এ বছর শিকাগো শহরে স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজে এক বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হয়েছেন ১৬ জন, আহত ২৪ জন এবং আব্রাহাম লিঙ্কন নিজেই তো তাঁর ওই বক্তৃতাদানের দুই বছরের মধ্যেই নিহত হন, আততায়ীর হাতে।

লিঙ্কন নিহত হওয়ার পর ১৫৭ বছর পার হতে চলেছে, দ্বিদলীয় ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থা তাঁর ‘গণতান্ত্রিক’ আমেরিকায় এখন চরম হুমকির মুখে পড়েছে; আগামী দিনে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হবে কি না, সে বিষয়েই এখন সংশয়। একটি জরিপ বলছে, তরুণ আমেরিকানদের মধ্যে এখন শতকরা ৯৩ জনই মনে করে যে তাদের দেশে ‘সুস্থ’ গণতন্ত্র নেই। লিঙ্কন জ্ঞানী এবং আশাবাদী মানুষ ছিলেন; কিন্তু তিনি ধারণা করতে পারেননি যে তাঁর দেশে পুঁজিবাদ এভাবে বিকশিত হবে এবং হওয়ার ফলে তাঁর সেই দেশ উপনিবেশবাদী গ্রেট ব্রিটেনের তুলনায়ও বড় রকমের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়ে যাবে। অপেক্ষা থাকবে কেবল সময়ের ও সুযোগের।

বিশ্বযুদ্ধকালে জাপান কিছু কম নৃশংসতার পরিচয় দেয়নি, কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে তারা শান্তিপ্রিয় বলেই পরিচিত; আমেরিকার ঠিক উল্টো। জাপানে বন্দুক আইন রীতিমতো কঠোর: রাজনৈতিক হিংস্রতার খবর পাওয়া যায় না, গোলাগুলির ঘটনা বিরল। সেই জাপানের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এক নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা করতে গিয়ে আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। দুই দফায় তিনি ৯ বছর দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আততায়ীটি বিক্ষুব্ধ ছিল, ওই ভাবে তার ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছে। ডেনমার্কও শান্তিপ্রিয় দেশ বলে খ্যাত। ছাড় দিয়ে দিয়ে কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে। সেই ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরের শপিং মলে এক বন্দুকধারীর গুলিতে তিনজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়েছেন।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ