বর্তমানে তরুণদের বেকারত্ব একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর যে শিক্ষা তাঁরা গ্রহণ করেছেন, তা যুগোপযোগী নয় বলে চাকরিও পাচ্ছেন না। যেকোনো বেকার মানুষের মনে অসহিষ্ণুতা স্বাভাবিক।
সম্প্রতি আমি একটি সেমিনারে গিয়েছিলাম। সেমিনারটি ছিল একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণাপত্রের ওপর। গবেষণাটি ছিল তরুণদের অসহিষ্ণুতার ওপর। বিভিন্ন পেশায় কাজ করা এবং বিভিন্ন ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তরুণদের সহিষ্ণুতা কোন পর্যায়ে আছে, তার ওপর মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়ার জন্য সমীক্ষাটি করা হয়েছে। সেই সমীক্ষার ফলাফল একটি গবেষণাপত্রে নিয়ে আসা হয়েছে, তার ওপরই আলোচনা। দেখা গেল ধর্মের বিষয়ে তরুণদের অসহিষ্ণুতা চরমে; বিশেষ করে তরুণীদের। ধর্মে কোনো রকম আঘাত করলে তাঁদের হত্যা করতে হবে—এ ধরনের গা শিউরে ওঠা নানান তথ্য গবেষণায় উঠে এসেছে। এনজিওতে কর্মরত তরুণ-তরুণীরাও যথেষ্ট অসহিষ্ণু। একমাত্র সহিষ্ণু দেখা গেল শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত তরুণ-তরুণীরা। জাতিগতভাবে আমাদের মধ্যে একটা অসহিষ্ণুতা দীর্ঘদিন ধরেই রয়ে গেছে। আমরা কাউকেই সময় দিতে চাই না, অপেক্ষা করতে চাই না। ছোট-বড় সব বিষয়েই দ্রুত সমাধান চাই। এই সমাধানের জন্য প্রয়োজনে কাউকে হত্যা করা বা কোনো প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেওয়া—এসব ব্যাপারেও আমরা খুবই সিদ্ধহস্ত। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার পেছনে ছাত্রদের একটা বড় ভূমিকা ছিল, কিন্তু এত দ্রুত একটি সংগঠন ছাত্রলীগকে ভেঙে দিয়ে আবার আরেকটি ছাত্রলীগের জন্ম দেওয়া হলো। সেই ধারায় একটি অত্যন্ত উগ্র রাজনৈতিক দল গড়ে উঠল। এই জাসদ দলটি পরবর্তীকালে একটি সশস্ত্র সংগঠনের জন্ম দেয়। যার নাম ‘গণবাহিনী’। গণবাহিনী দেশের অভ্যন্তরে অনেক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হয়ে গেল। বিন্দুমাত্র সহিষ্ণুতা না দেখিয়ে নিজের দলের লোকদেরই হত্যা করতে শুরু করল। এরপর দলটি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেল। শক্তির অপচয় হতে হতে এখন দুর্বল হয়ে গেছে। এসবের ফলাফলে সুবিধা হয় স্বৈরাচারী শাসকদের। এই শাসকদের আবার অসহিষ্ণুতা চরমে। কাউকে ফাঁসি দিয়ে, জেলে ঢুকিয়ে অথবা নানাভাবে নিপীড়ন করে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়। অসহিষ্ণুতার নিষ্ঠুরতার ফলাফল বহুবিধ। এর একটি হচ্ছে হঠকারিতা। জাসদ এবং অন্যান্য সশস্ত্র রাজনৈতিক দল সব সময়ই তরুণ মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে পারে। কারণ, তারা দ্রুত সমাজ পরিবর্তন চায় এবং এই দ্রুত সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় তারা নিজের জীবনকে বলি দেয়। শুধু তা-ই নয়, তারা রাজনৈতিকভাবে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। ৫১ বছরে অনেক বিপ্লবী তরুণকে দেখেছি সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় এমন সব ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যার ফলে সমাজ পরিবর্তন তো সম্ভব হয়ইনি; বরং সমাজ উল্টো পথে চলে গেছে। যেখানে একটি শোষণহীন সাম্যবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁরা সংগ্রাম করেছেন, এর বদলে ধর্ম একটা মুখ্য রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ধর্ম নানান তরিকায় বিভক্ত। ইসলাম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ—সব ধর্মেই নানান ধরনের বিভাজন আছে। প্রতিটি বিভাজনে আবার স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা রয়েছে। কখনো কখনো একই ধর্মবিশ্বাসীরা নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। আবার প্রতিটি বিভাজনে রয়েছে নিজস্ব মতবাদ ও শিক্ষাপদ্ধতি। এই শিক্ষার জন্য রয়েছে তাঁদের নিজস্ব শিক্ষায়তন। শিক্ষার্থীরা নানাভাবে বিভক্ত হয়ে, নানান শিক্ষায়তনে পাঠ শেষ করে সমাজজীবনে প্রবেশ করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জীবনের ব্যবহারিক দিকগুলো তাঁদের মধ্যে অনুপস্থিত থাকে। ইহকালের চেয়ে পরকালের ভাবনায় সাধারণত তাঁরা মগ্ন থাকেন। কিন্তু এই ধর্মপ্রাণ তরুণেরা কালক্রমে ধর্মভীরুতে পরিণত হন। ঠিক সেই সময়ই কিছু উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার মাধ্যমে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। এই রাজনৈতিক ব্যবহারের বলয়টি ৫০ বছর ধরে ক্রমাগতভাবে কখনো সুপ্ত, উজ্জীবিত এবং কখনো তা জঙ্গি আকার ধারণ করে ফেলে। মূল ধারার দলগুলো নিজেদের মধ্যে আপস করে না কিন্তু ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে আপসরফা করে ফেলে। এই আপসরফা তাঁদের আরও বেশি উজ্জীবিত ও অসহিষ্ণু করে তোলে।
সমীক্ষাটি পড়ে এটাই মনে হয়, তাঁরা দ্রুত একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র চান। যে রাষ্ট্রে অন্য কোনো ধর্মের মানুষ বসবাস করতে পারবেন না। ইসলামে সহাবস্থানের যে রীতি-নীতি, তার ধারেকাছেও তাঁরা নেই। পেশিশক্তি দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতাকে দখল করতে চান। মধ্যযুগে অস্ত্রের শক্তিতে রাষ্ট্র দখল এবং রাষ্ট্র নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এটা যে অসম্ভব, তা তাঁদের শিক্ষকেরা কখনোই বোঝানোর চেষ্টা করেন না। শিক্ষকদের পাশাপাশি ধর্মীয় রাজনৈতিক নেতারা বরং একটা উসকানিমূলক আচরণ করে তাঁদের চরম অসহিষ্ণু করে তোলেন। পৃথিবীতে পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র এবং আরও নানা ধরনের রাজনৈতিক মতবাদের আপাত ব্যর্থতা তাঁদের অনুপ্রাণিত করে থাকে।
বর্তমানে ইরানে মৃত্যুদণ্ডের ভয় দেখিয়ে সেখানকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করার একটা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডটি আবার ধর্মের নামে। আপসকামী রাষ্ট্রনায়কেরা নিজেরাও ধর্মভীরু। ধর্মীয় অনুশাসনকে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত করাতে তাঁরা অভ্যস্ত। পাকিস্তানের ২৪ বছর আমাদের জীবনে ধর্ম কীভাবে একটি দেশের উন্নয়ন, মানবিকতা, আইনকানুন ইত্যাদিকে অস্ত্র দিয়ে দমন করেছে, তা আমরা দেখেছি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে এই প্রাচীন নিয়ম অত্যন্ত কার্যকর। তাই ৭৫ বছর ধরে পাকিস্তান এই প্রাচীন পদ্ধতিটিকে গ্রহণ করে আসছে। যে কারণে পাকিস্তানের রাজনীতিতে কোনো প্রগতিশীল উপাদান আসতে পারেনি। এখনো সেখানে সেনাবাহিনী ধর্মান্ধতা দিয়ে সব গণতান্ত্রিক অধিকারকে কবজা করে রেখেছে। ধর্মের ভিত্তিতে যে দুটি দেশকে ব্রিটিশ ভিক্ষা দিয়ে গেল, সেই দুটি দেশেই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার একটা মুখ্য শক্তি হিসেবে বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছে। আফগানিস্তানে ধর্মই মুখ্য রাজনৈতিক শক্তি, কিন্তু পাশাপাশি মানুষের দুর্দশারও অন্ত নেই। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্যদিকে একেবারেই কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘটেনি। অদৃষ্টবাদী মানুষগুলো বিজ্ঞানকে উপেক্ষা করে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর প্রগতিশীলেরা দেশত্যাগ করাটা একমাত্র সমাধান বলে বিবেচনা করেছে। এই বিবেচনায় পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে আফগান শরণার্থীদের চাপ লক্ষণীয়।
বহু যুগ আগে ফরাসি বিপ্লবের সময় রাষ্ট্রে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছে। সবাই মেনে নিয়েছিল ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। ধর্ম যার যার উৎসব সবার। এগুলো শুধু নিছক রাজনৈতিক স্লোগান ছিল না, সারা বিশ্বে এর একটা প্রভাব পড়েছিল। সেই প্রভাবে দেশে দেশে স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল। গণতন্ত্র এবং সাম্যের বাণী পৌঁছেছিল সারা বিশ্বে। বিশ্বের প্রগতিশীল মানুষদের মধ্যে সেই প্রেরণা এখনো কাজ করে যাচ্ছে। মানুষের ন্যূনতম চাহিদার মধ্যে যেমন অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা রয়েছে, তেমনি আছে ব্যাখ্যাতীত কিছু বিষয়। সে বিষয়টিও উপেক্ষা করার নয়। কেউ কেউ এ ক্ষেত্রে ধর্মকে বেছে নেয়। কিন্তু আজকের দিনে ধর্মের রাজনীতি যাঁরা করেন, তাঁদের অর্থেরও শক্তি আছে এবং অবৈধ পথে বিত্তবান মানুষেরাও এ ক্ষেত্রে অর্থ দিতে দ্বিধা করেন না। ফলে বড় ধরনের একটা অর্থের জোগান পেয়ে যায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা ছোটবেলা থেকে আবাসিক মাদ্রাসায় বড় হয়ে থাকেন। সেই মাদ্রাসার ভেতরেও অনেক অনাচার তাঁরা দেখতে পান। কেউ কেউ প্রতিবাদ করেন। কেউ সেখান থেকে বেরিয়ে এসে সাধারণ স্কুল-কলেজে অবিস্মরণীয় প্রতিভার প্রমাণ দেন। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে যাঁরা রয়ে গেলেন এবং কোনো জীবিকার ব্যবস্থা হলো না, তাঁরা অসহিষ্ণুতার কাছেই নিজেদের সমর্পণ করেন। বর্তমানে তরুণদের বেকারত্ব একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর যে শিক্ষা তাঁরা গ্রহণ করেছেন, তা যুগোপযোগী নয় বলে চাকরিও পাচ্ছেন না। যেকোনো বেকার মানুষের মনে অসহিষ্ণুতা স্বাভাবিক। বর্তমানে ধর্মীয় শিক্ষালয় সংখ্যার দিক থেকে একটা বিশাল আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে ব্যাপকভাবে অসাধুতার কাহিনিও শোনা যায়। অস্তিত্বহীন কিছু মাদ্রাসা নিয়মিত অনুদান পেয়ে যাচ্ছে। সেই সব প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের কর্মকাণ্ডও জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছে।
যেখান থেকে শুরু করেছি, সেই তরুণদের অসহিষ্ণুতার কথা, সেখানে ফিরে যাই—এ কথা সত্যি, তরুণেরা স্বভাবতই অসহিষ্ণু। এই অসহিষ্ণু তরুণদের সহিষ্ণু করার জন্য প্রতিনিয়ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়োজিত থাকে। শিক্ষক, সমাজের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা নিরন্তর চেষ্টা চালান। কিন্তু রাজনীতির দাবা খেলায় ব্যবহৃত হতে গিয়ে এই তরুণেরা কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এই কাণ্ডজ্ঞান হারানোর ফলে কোনো অসহিষ্ণুতার কারণে নিজের জীবনটাই একসময় বিপন্ন হয়ে পড়ে। এই বিপন্নতা সমাজের বড় বিপর্যয় ডেকে আনছে। আমরা কি তা দেখতে পাব না?
লেখক: মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব