ছেলেবেলার দুটো অস্বাভাবিক ঘটনার কথা জীবনে ভোলেননি জসীমউদ্দীন। বড় হয়ে কবি হবেন, তা হয়তো তখন তিনি জানতেন না, কিন্তু মানুষ হতে হবে, সেটা বুঝতে পারতেন। একবার স্কুলের পরীক্ষার সময় প্রশ্নপত্র হাতে পেয়েছেন। পাতলা কাগজে লেখা যায় না বলে পাঠ্যবইটা তিনি রেখেছিলেন কাগজের তলায়। প্রশ্নপত্র খুবই সহজ হয়েছিল। মনের আনন্দে উত্তর লিখতে শুরু করলেন জসীমউদ্দীন। খাতার নিচে যে বইটা রয়েছে, সে কথা বেমালুম ভুলে গেলেন তিনি। তন্ময় হয়ে লিখছেন যখন, তখন কোথা থেকে হেডমাস্টার এসে জসীমের খাতার তলা থেকে বইটা বের করে আনলেন। তারপর জসীমকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন ডেস্কের সামনে। এরপর বেদম বেত্রাঘাত করলেন। জসীম যতই বলতে চান না কেন, ভুলবশত বইটা ছিল খাতার তলায়, একটা লাইনও নকল করেননি—কিন্তু কে শোনে কার কথা? মার খেয়েছেন, তাতে দুঃখ ছিল না, কিন্তু সবাই ভাবল যে জসীম নকল করে, এটা নিয়েই অপমানে জর্জরিত হয়েছিলেন তিনি।
বাবু হেরম্বলাল দাস নামে একজন নতুন শিক্ষক এলেন স্কুলে। অমায়িক লোক ছিলেন তিনি। তাঁর হাতের লেখা ছিল ছাপানো অক্ষরের মতো। ছাত্রদের মারধর করতেন না।
একদিন হেরম্ব স্যারের ক্লাসে কোনো এক বিষয়ে তাকে ঘিরে ছাত্ররা গন্ডগোল করছিল। এ সময় হেডমাস্টার ঢুকলেন সেই ঘরে। অন্য অনেক ছাত্র গোলমাল করলেও তিনি জসীমকেই পাকড়াও করলেন এবং বেদম বেত্রাঘাত করলেন। বেতের আঘাতে জসীমের পিঠে দড়ির মতো সাত-আটটি দাগ পড়ল। পরের ক্লাসটাই ছিল জসীমউদ্দীনের বাবার। তিনি এসে দেখেন, ছেলে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জসীমকে জিজ্ঞেস করলেন। জসীম উত্তর না দিয়ে পিঠের দড়িগুলো দেখালেন বাবাকে। বাবা জসীমকে নিয়ে গেলেন স্কুলের সেক্রেটারির কাছে। তিনি বললেন, ‘তাই তো! শাস্তিটা একটু কঠোরই হয়েছে।’
পরদিন থেকে জসীম সেই হেডমাস্টারকে আর দেখেননি। পরে জেনেছেন, জসীমের বাবার সঙ্গে এই হেডমাস্টারের মনোমালিন্য ছিল। তাই তাঁর বাবাকে কিছু করতে না পেরে ছেলেকে মেরে মনের ঝাল মিটিয়েছিলেন তিনি!
সূত্র: জসীমউদ্দীন, জীবন কথা, পৃষ্ঠা ১১৩-১১৪