হোম > ছাপা সংস্করণ

সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থে সরকারি নীতি গ্রহণ

ড. মইনুল ইসলাম

সম্প্রতি সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় আদেশ জারি করেছে যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের যেসব গ্রাহক তাঁদের টেলিভিশনে স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখতে চান, তাঁদের ৩০ নভেম্বরের মধ্যেই ‘সেট টপ বক্স’ কিনে লাগিয়ে নিতে হবে, নয়তো তাঁদের টেলিভিশনে কোনো ডিজিটাল চ্যানেল পাওয়া যাবে না। দেশের বাকি অংশের গ্রাহকদের পরে পর্যায়ক্রমে সেট টপ বক্স লাগাতে হবে। ভারতের উদাহরণ টেনে ওই আদেশের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে দাবি করা হয়েছে যে, সেট টপ বক্স স্থাপন করলে গ্রাহকেরা নিজেদের পছন্দমতো কম বা বেশি টেলিভিশন চ্যানেল বেছে নিয়ে ব্যয়সাশ্রয় করতে পারবেন। আসলে এই ব্যয়সাশ্রয়ের দাবিটা সত্য নয়।

একটি রিট পিটিশন দাখিলের সুবাদে গত ২২ নভেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ওই আদেশটির কার্যকারিতা এক মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন। এ আদেশটি কী উদ্দেশ্যে তথ্য মন্ত্রণালয় জারি করেছে? প্রকৃতপক্ষে সেট টপ বক্স স্থাপনের জন্য গ্রাহকদের প্রতি টেলিভিশনে অতিরিক্ত তিন-চার হাজার টাকা ব্যয় করতে সরকার কেন বাধ্য করছে, সেটা মোটেও পরিষ্কার নয়। সন্দেহ করার কারণ রয়েছে যে জনৈক উপদেষ্টার মালিকানাধীন একটি স্যাটেলাইট ডিশ কোম্পানিকে অন্যায় সুবিধা দেওয়ার জন্য এবং পাশাপাশি সেট টপ বক্স আমদানিকারক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক মুনাফা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় এই অপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থাটি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে, যার মাধ্যমে দেশের জনগণকে অহেতুক হয়রানি ও অতিরিক্ত ব্যয়ের বাধ্যবাধকতায় জিম্মি করা হচ্ছে। ভোক্তাদের পকেট কেটে সরকারের উচ্চপদে আসীন কারও কিংবা তাঁদের আত্মীয়স্বজন ব্যবসায়ীদের সুবিধা প্রদানের এহেন অপপ্রয়াসকে ‘অবৈধ’ রায় দেওয়ার জন্য হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিদের কাছে আরজি জানাচ্ছি। চলমান কেব্‌ল ব্যবস্থায় বর্তমান কেব্‌ল টেলিভিশন ব্যবহারকারীদের কারও তেমন কোনো অসুবিধে হচ্ছে বলে কোনো খবর আমাদের জানা নেই। তাই আরেকটি নতুন পদ্ধতি চালুর প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিল, তা বোঝা যাচ্ছে না! সেট টপ বক্স স্থাপন ঐচ্ছিক রাখলে অসুবিধে কোথায়?

এ বিষয়টার অবতারণা করতে হলো ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর সরকারে দেশের রাঘববোয়াল বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর স্থানলাভের পর উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাঁদের অন্যায় সুবিধা প্রদানের জন্য সরকারের বেশ কয়েকটি নীতি পরিবর্তনের নজির স্থাপনের কারণে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক নজিরটি স্থাপিত হয়েছে কয়েকজন রাঘববোয়াল ঋণখেলাপির নাম খেলাপির তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য খেলাপি ঋণের নিয়মকানুন অভূতপূর্বভাবে বদলে ফেলার উদ্দেশ্যে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে। ব্যাংকিং খাতের মারাত্মক খেলাপি ঋণ সমস্যাটিকে এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থকে কীভাবে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলা হলো, সেটা সাধারণ জনগণ হয়তো বুঝতে পারবেন না। প্রকৃত খেলাপি ঋণ যেখানে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, সেখানে এসব অনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি নামিয়ে ফেলা হয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপিও এস‘ব পদক্ষেপের মাধ্যমে তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম ঋণখেলাপির তালিকা থেকে গায়েব করে দিতে সমর্থ হয়েছেন। কিন্তু গত তিন বছরে তিনি খেলাপি ঋণের কত শতাংশ প্রকৃতপক্ষে ব্যাংককে ফেরত দিয়েছেন, সে তথ্যটা সাহস থাকলে জানাতে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ সমস্যার আদৌ কোনো উন্নতি হয়েছে?

সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থ গুরুতর জাতীয় সমস্যাগুলোকে লুকিয়ে ফেলা মন্ত্রীদের কাজ হতে পারে না। আরেকটি নীতিও খুবই দৃষ্টিকটুভাবে একটি মহলের সংকীর্ণ স্বার্থে নেওয়া হয়েছিল, ভারত থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আমদানির দায়িত্ব। ওই নীতির মাধ্যমে বেক্সিমকোকে অন্যায্য মুনাফা করার সুযোগ প্রদান করা হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে যে একটি ‘ব্যবসায়ীদের সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার আলামত সরকারের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপে এভাবে নগ্নভাবে উন্মোচিত হচ্ছে। ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রিসভায় কিংবা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টামণ্ডলীতে স্থানলাভ অন্যায় সুবিধালাভের জন্য অপব্যবহার করা অনৈতিক। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বাধীন সরকারের এহেন অনৈতিক ব্যবসায়ীপ্রীতি আমাদের কাছে কোনো দিনই গ্রহণযোগ্য হবে না। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন, ‘বিশ্বে দুই ধরনের মানুষ রয়েছে, শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ তাহলে, বঙ্গবন্ধুকন্যা ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের’ লালন করছেন কেন?

দেশের উন্নয়ন-দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশের পথ ও গতি-প্রকৃতির পার্থক্য বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এই ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিস্ট’ লালনকারী চরিত্রটা সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। ভিয়েতনাম ১৯৭৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের থাবা থেকে মুক্ত হয়ে যখন একটি ধ্বংসস্তূপ হিসেবে উন্নয়নের পথ-পরিক্রমা শুরু করেছিল, তখন ভিয়েতনামের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপির চেয়ে অনেক কম ছিল, মাত্র ৮৫ ডলার। ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে শুরু হয়েছিল ১৯৪৫ সালে, ঔপনিবেশিক প্রভুরাষ্ট্র ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ৯ বছরের স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে। ১৯৫৪ সালে ভিয়েতনামের জাতির পিতা হো চি মিনের নেতৃত্বে এবং জেনারেল গিয়াপের সমর-নৈপুণ্যে দিয়েন বিয়েন ফুর যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে ফরাসি উপনিবেশবাদীদের ইন্দোচীন থেকে হাত গোটাতে বাধ্য করতে সমর্থ হলেও তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারের সাম্রাজ্যবাদী খায়েশ ভিয়েতনামিদের আবারও বাধ্য করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর বিপক্ষে ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয়বার যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে, যে যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত ধ্বংসাত্মক কোনো যুদ্ধ বিশ্বে আর সংঘটিত হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন, কিন্তু ভিয়েতনামে প্রায় ৫০ লাখ ভিয়েতনামিকে হত্যা করেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করে ১৯৭৫ সালে লেজ গুটিয়ে পালাতে হয়েছিল। ৩০ বছরের এই দু-দুটো মুক্তিযুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনামের সংগ্রামী জনগণকে খাঁটি সোনায় পরিণত করেছে। সে জন্যই ১৯৮৬ সালে দেশের প্রয়োজনে ভিয়েতনামের রাষ্ট্র-নেতারা ‘দোই মোই’ নামের সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে তাঁদের সমাজতান্ত্রিক পথের দোষত্রুটি সংশোধনের ব্যবস্থা করেছেন। ৩৫ বছরে ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সারা বিশ্বের জন্য একটি অভূতপূর্ব সাফল্যের ইতিহাস উপহার দিয়ে চলেছে। গণচীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে উন্নয়ন-বিশেষজ্ঞরা মাতামাতি করছেন অহরহ, অথচ চীনের পার্শ্ববর্তী সমাজতান্ত্রিক দেশ ভিয়েতনামে যে অনেকখানি ভিন্ন চরিত্রের অর্থনৈতিক নীতিমালা অনুসরণ করে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জিত হয়ে চলেছে, সেটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে না।

এই ৩৫ বছরে ভিয়েতনামের মাথাপিছু জিডিপি ৬ হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে, ক্রয়ক্ষমতার সাম্যের (পিপিপি) ভিত্তিতে তাদের মাথাপিছু জিডিপি ১০ হাজার ডলার অতিক্রম করেছে। ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় ৩৪২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, বাংলাদেশের রপ্তানি আয় এখনো ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশ উভয় দেশই সমাজতন্ত্রকে এখনো রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে অনুসরণ করার কথা, কিন্তু পার্থক্য হলো বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র হলো শুধুই বাত্-কা-বাত্। ভিয়েতনামের কোনো মন্ত্রী ব্যবসায়ী-ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসেননি, কিন্তু তাতে কি ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক নীতিমালার কারণে জনগণ কিংবা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?

৩৫ বছরে ভিয়েতনামের জনগণের আয়বৈষম্য-পরিমাপক জিনি (বা গিনি) সহগ ০.৩৫-এ স্থির রয়ে গেছে, অথচ বাংলাদেশের জিনি সহগ ২০১৬ সালের হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) মোতাবেক দ্রুত বেড়ে ০.৪৮৩-এ পৌঁছে গেছে। (কোনো দেশের জিনি সহগ ০.৫ অতিক্রম করলে ওই দেশকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ আখ্যায়িত করা হয়)। মার্কিন গবেষণা প্রকাশনা ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা-ওয়েলথ রিপোর্ট’ মোতাবেক, বাংলাদেশ অতি-ধনী ব্যক্তিদের সংখ্যাবৃদ্ধির দৌড়ে ২০১৮ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বাংলাদেশের ওই বছরের নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে আসীন সাংসদদের মধ্যে ৬২ দশমিক ৭ শতাংশই ব্যবসায়ী। প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টামণ্ডলীতে যেসব ব্যবসায়ী স্থান পেয়েছেন, তাঁদের কয়েকজনের ইমেজ কি আদৌ গ্রহণযোগ্য? এটাই কি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ? কয়েক হাজার কোটিপতি বাংলাদেশের আয় এবং সম্পদের সিংহভাগ লুটেপুটে খাচ্ছে, তাদের কারণেই দেশের মাথাপিছু জিডিপির দ্রুত প্রবৃদ্ধি প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণ জনগণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল কতখানি পাচ্ছেন? আর সে জন্যই কি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা-ধন্য ব্যবসায়ীদের সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থে সরকারের নীতি গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে?

ড. মইনুল ইসলাম
অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ