বিএনপি এবং কিছু কিছু দল আগামী নির্বাচন উপলক্ষে দেশে একটি দল-নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে। তারা বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বলেও জোর দিয়ে বলছে। তাদের দল-নিরপেক্ষ সরকারের যুক্তির ভিত্তি হিসেবে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনকে হাজির করছে। তাদের বক্তব্যে যেমন কিছু যৌক্তিকতা আছে আবার অনেক কিছুই তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যামতে। তা ছাড়া, দল-নিরপেক্ষ সরকারের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। দল-নিরপেক্ষ সরকারের অভিজ্ঞতা ১৯৯০-৯১ তে একভাবে হয়েছিল। আবার ১৯৯৬-২০০৮ পর্যন্ত অন্যভাবে হয়েছিল। সে কারণে যারা এখন দল-নিরপেক্ষ সরকারের দাবি করছে, তারাও জোর দিয়ে করতে পারছে না, ১৯৯০-৯৬-এর মতো সমর্থনও পাচ্ছে না। নব্বইয়ের দশকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটি ছিল সাময়িক সংকট থেকে উত্তরণের চিন্তা। সে কারণে বিষয়ের গভীরে না গিয়ে এটি অনেকটা সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানের প্রেসক্রিপশন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতার হাতবদল সাময়িক কোনো প্রেসক্রিপশনে সমাধানযোগ্য নয়। সেই অভিজ্ঞতা তখন গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা না গেলেও পরবর্তী অভিজ্ঞতায় সংকটের নতুন নতুন জটিলতা অবধারিতভাবে রাষ্ট্রকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে, তেমন অভিজ্ঞতাই সঞ্চিত হয়েছে। সে কারণে নির্বাচনকালীন দল-নিরপেক্ষ সরকারের দাবি নিয়ে এখন জনসমর্থন সেভাবে স্বতঃস্ফূর্ততা পাচ্ছে না। একসময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার পর দাবি করা হয়েছিল, বিশ্বের অনেক দেশেই এটি অনুসরণ করা হবে। কিন্তু বাংলাদেশের দুই-তিনটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ক্রমেই রাষ্ট্রকে ক্ষমতার হাতবদলের নানা অশুভশক্তির দিকে ধাবিত করার আশঙ্কা থেকে যেসব রাষ্ট্র ভাববে বলে অনুমান করা হয়েছিল, তার কোনোটিই ঘটেনি। ২০১১ সালের মে মাসে দেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে একটি রায় প্রদান করেন। এই রায়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ৩৪২ পৃষ্ঠায় যুক্তি, তথ্য, প্রমাণ ও দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইনের নানা খুঁটিনাটি উপস্থাপন করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা অনির্বাচিতদের হাতে যাওয়ার বিধান অসাংবিধানিক এবং অগণতান্ত্রিকও বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
এই রায় পরে জাতীয় সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পাস হয়। বিরোধী দলগুলো এই রায় এবং সাংবিধানিক সংশোধনীর বিরোধিতা করেছে। তবে ৩৪২ পৃষ্ঠার রায়টিতে আইন, রাষ্ট্র ও সংবিধানের অন্তর্নিহিত বিষয়গুলোকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের দৃষ্টি ও বিবেচনাকে বিশেষভাবে চিন্তা করতে সহায়তা করেছে। যদিও আমাদের দেশে অনেকেই রাজনৈতিক সুবিধা ও বিবেচনাপ্রসূত অবস্থান থেকে এর সমালোচনা ও আক্রমণগুলো পোষণ করে আসছে। কিন্তু বর্তমান যুগের রাষ্ট্রব্যবস্থার সাময়িক কিংবা দীর্ঘমেয়াদি হস্তান্তরের জটিলতা সম্পর্কে অনেকেই অতলস্পর্শী ধারণা নিয়ে ভাবতে চায়। তবে সেই ভাবনার মধ্যে লুকিয়ে থাকে অনেক জটিল সংকট সৃষ্টির সুযোগ।
বাংলাদেশে সত্তর ও আশির দশকে সামরিক দুই সরকারের অধীনে বেশ কিছু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেগুলো অনেকটাই ছিল সামরিক সরকারগুলোকে বৈধতা দেওয়া। নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোকে শিখণ্ডি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে দল প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই দলকে নিরঙ্কুশ বিজয়ী করে আনা কিংবা রাষ্ট্রপতিকে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোট অথবা দৃশ্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কিন্তু কার্যত পূর্বপরিকল্পিত ছকে সামরিক শাসক এবং শাসক দলকে জিতিয়ে আনার নতুন নতুন অভিজ্ঞতা থেকেই দেশে নির্বাচনব্যবস্থার ওপর অনাস্থা তৈরি হতে থাকে। এর ফলে সরকার উৎখাতের আন্দোলন তীব্রতর হয়। সেই আন্দোলন ১৯৯০ সালে এসে নতুন বাঁক নেওয়ায় স্পষ্ট অনুমিত হতে থাকে যে সরকার উৎখাতের পর রাষ্ট্রের শূন্যতা পূরণে একটি সরকার প্রয়োজন। সেটি প্রায় সর্বসম্মতভাবে মেনে নেওয়া এবং বোধগম্যতার ফলে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিকে বিদায়ী রাষ্ট্রপতির স্থলে বসিয়ে ৯০ দিনের মধ্যে একটি নির্বাচন করার ব্যবস্থা করা হয়।
ওই সংসদে সংবিধানের ৫৮তম অনুচ্ছেদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি রূপরেখা প্রণয়নে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করা হয়। ৫৮ অনুচ্ছেদে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সদ্যবিদায়ী প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি সরকার গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। তখন সবাই এটিকে নির্বাচনব্যবস্থায় আস্থা ফিরিয়ে আনার মহৌষধ মনে করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর বাস্তবে এর গঠন এবং কার্যকারিতা নিয়ে অভিজ্ঞতা দ্রুতই ফিকে হতে থাকে। সদ্যবিদায়ী প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু বঙ্গভবন এবং গণভবনের মধ্যেই নয়, আরও কয়েকটি স্থানেও টানাটানি শুরু হয়ে যায়। নির্বাচনের প্রচারের তুঙ্গকালেই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটার আলামত দৃশ্যমান হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং রাজনৈতিক মহলের চাপে সেই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়। যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম অভিজ্ঞতায় বড়সড় ধাক্কা খায়। দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় ২০০১ সালের ১৫ জুলাই সদ্যবিদায়ী প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে। শপথ গ্রহণের আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তুতি গ্রহণের অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে। শপথের পরপরই তিনি সচিবসহ বিভিন্ন পদে ব্যাপক রদবদলের যে আদেশ জারি করেন, তা নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির পরিবর্তে বিদায়ী সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দল ও জনমত তৈরির মানসিকতা সৃষ্টিতে সহায়তা করে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয় নির্বাচনী প্রচারে, কিছু অদৃশ্যশক্তি আওয়ামী লীগের প্রার্থী, ভোটার এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চলাচল, ভোটদান ইত্যাদির ক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে এবং পরে দেশে একটি রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে এবং একটি জোটের পক্ষে ছড়িয়ে যেতে দেখা যায়। এখানেই সুষ্ঠু, অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের ধারণার ব্যত্যয় ঘটে। নেপথ্যে কে বা কারা কলকাঠি নাড়িয়েছিল, সেটি আজও রহস্যাবৃত। বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের এই নেপথ্য শক্তি কতটা শক্তিশালী ও ক্রিয়াশীল, সেটি ২০০১ সালের নির্বাচনে অনেকটা উন্মোচিত হয়।
জোট সরকার পরবর্তী পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ এবং অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে নির্মূল করার বাইরে কোনো আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক সংস্কার ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মনোযোগ দেয়নি। সরকার পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলার জন্য বিচারপতিদের বয়স বাড়াতেও দ্বিধা করেনি। পরবর্তী নির্বাচন নিজেদের ব্লুপ্রিন্ট মতো করতে সরকারপ্রধান সরাসরি জড়িতছিলেন। এ নিয়ে দেশে রাজনৈতিক সংকট তীব্রতর হয়। বিএনপি এবং জোটের মধ্যেও ভাঙন সৃষ্টি হয়। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের সেই তীব্র উত্তেজনাকর মুহূর্তগুলো বাংলাদেশে আবার ফিরে আসবে— এটি আগে কেউ ভাবতে পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক অনুচ্ছেদ (৫৮) ভঙ্গ করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সদ্যবিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কবর সেদিনই রচিত হয়েছে। সেই দায় বিএনপি-জামায়াতেই। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চারজন উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের রহস্যাবৃত ভূমিকায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। নির্বাচন কমিশনেও চলছিল তুঘলকি কাণ্ড। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শূন্য চার পদে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁরাও এই জটিল পরিস্থিতি অনুধাবনে ব্যর্থ ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এবং নির্বাচন কমিশন ২১ জানুয়ারি ২০০৭-এ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অটল ছিলেন। দেশে তখন তীব্র আন্দোলন চলছিল। সে অবস্থায় বিনা ভোটে একের পর এক চারদলীয় জোটের প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হচ্ছিল। দেশ-বিদেশে এ ধরনের নির্বাচন নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনী রাষ্ট্রপতিকে বাধ্য করে নির্বাচন বন্ধ করে দিতে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে দিতে। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করে নতুন আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন। এর কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ছিল। ত্ত্বাবধায়কসরকারব্যবস্থার নামে ২০০৬-০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশে যা ঘটেছিল তা নজিরবিহীন এবং দেশের জন্য বিপজ্জনক। এমন ভয়ংকর অভিজ্ঞতা থাকার পর নতুন করে নির্বাচনকালীন দল-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিকল্পনা ফানুসের চেয়ে কম ওজনদার বললেও অত্যুক্তি হবে না।