লিখতে বসে এখন একধরনের ক্লান্তি বোধ করি। সেই কত বছর ধরে রাজনৈতিক বিষয়ে লিখছি, কিন্তু নতুন কিছু লিখতে পারি না।আমাদের দেশের রাজনীতিতে নতুন কিছু ঘটে না। মাঝে মাঝে অনেক কিছু রটে, কিন্তু তার সামান্যই ঘটে। যেমন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বৃত্তের বাইরে আমরা যেতে পারলাম না। সেই হাসিনা, সেই খালেদা। মধ্যে একজন এরশাদ ছিলেন, তিনিও গত হয়েছেন। কতবার কত জন কত আশা শোনালেন, তৃতীয় শক্তি, বিকল্প শক্তির কথা কত শুনলাম, কিন্তু সেই শক্তির আর দেখা পেলাম না। পরে দেখা যায় সব শক্তি ঘুরেফিরে দুই পক্ষের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করে।
গণতন্ত্র নিয়েই কি আমরা কম কথা শুনলাম। রাজনৈতিক দলের—কি ক্ষমতাসীন, কি ক্ষমতার বাইরে থাকা–সবাই গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছু চায় না। রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রচর্চার নমুনা কী? দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য যে দলগুলোর জান আনচান করে, সেই দলগুলোর নেতৃত্ব নির্বাচন-প্রক্রিয়া কতটুকু গণতান্ত্রিক? দল চলবে স্বেচ্ছাচারী পদ্ধতিতে আর তাঁরাই দেশ চালাতে চান গণতান্ত্রিক উপায়ে।স্ববিরোধিতা আর কাকে বলে!
আমরা সরকার চাই রাজনৈতিক। রাজনৈতিক দলের সরকার না হলে আমাদের মন কেমন করে। অথচ এই আমরাই আবার নির্বাচন চাই অরাজনৈতিক সরকারের অধীনে। আমরা নির্বাচনকালীন সরকার চাই নিরপেক্ষ। ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তিদের প্রতি যদি আমাদের এত আস্থা-বিশ্বাস, তাহলে এই নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সরকার বা দেশ চালানোর দায়িত্ব দিতে অনীহা কেন? অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা নির্বাচন তত্ত্বাবধান করে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে পাঁচ বছরের জন্য দেশ পরিচালনার ভার তুলে দেবেন, এটা কি খুব সম্মানের বিষয়? আমরা সমস্যার গোড়ায় হাত দিতে চাই না। ডালপালা নিয়ে টানাটানিতেই সময় শেষ।
লেখার এই পর্যায়ে এসে হঠাৎ নজরে এল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘চেঁচিয়ে বলা’ নামের একটি প্রবন্ধ। প্রবন্ধের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘আজকাল সকলেই সকল বিষয়েই চেঁচিয়ে কথা কয়। আস্তে বলা একেবারে উঠিয়া গিয়াছে। চেঁচিয়ে দান করে, চেঁচিয়ে সমাজ সংস্কার করে, চেঁচিয়ে খবরের কাগজ চালায়, এমন-কি, গোল থামাইতে গোল করে। সেকরা গাড়ি যত না চলে, ততোধিক শব্দ করে; তাহার চাকা ঝন ঝন করে, তাহার জানলা ঝর ঝর করে, তাহার গাড়োয়ান গাল পাড়িতে থাকে, তাহার চাবুকের শব্দে অস্থির হইতে হয়।
বঙ্গসমাজও আজকাল সেই চালে চলিতেছে, তাহার প্রত্যেক ইঞ্চি হইতে শব্দ বাহির হইতেছে। সমাজটা যে চলিতেছে ইহা কাহারও অস্বীকার করিবার জো নাই; মাইল মাপিলে ইহার গতিবেগ যে অধিক মনে হইবে তাহা নহে, কিন্তু ঝাঁকানি মাপিলে ইহার গতি-প্রভাবের বিষয়ে কাহারও সন্দেহ থাকিবে না। ঝাঁকানির চোটে আরোহীদের মাথায় মাথায় অনবরত ঠোকাঠুকি লাগিয়াছে, আর শব্দ এত অধিক যে, একটা কথা কাহারও কর্ণ-গোচর করিতে গেলে গলার শির ছিঁড়িয়া যায়।’
রবীন্দ্রনাথ প্রায় শত বছর আগে এই প্রবন্ধ লিখেছেন। শত বছরে দুনিয়ায় কত পরিবর্তন হলো, রাজনৈতিক মানচিত্রে কত বদল ঘটল, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হলো, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার পতন হলো, মরণোন্মুখ পুঁজিবাদের শক্তি কমল না আরও কত-কী! কত আবিষ্কার, বিজ্ঞানের জয়জয়কার আবার ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িও চরম। যুক্তিতর্কের জায়গা দখল করেছে আবেগ। আর বাঙালি আছে সেই ‘চেঁচিয়ে বলা’র দলেই।
এখন চেঁচামেচি চলছে ১০ ডিসেম্বর নিয়ে। সরকার ও বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে। দুই দলের নেতারা চেঁচিয়ে যেসব কথা বলছেন তা যদি সত্যি হতো তাহলে কী হতো—ভেবে কূলকিনার করতে পারছি না। দুচোখে ঘুম এসে যায়। বিএনপি ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে অনড়। আর সরকার তাদের ঠেলে দিতে চায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কোন পক্ষের কথা ঠিক হবে বলা মুশকিল। যদি নয়াপল্টনেই বিএনপির সমাবেশ হয়, তাহলে কি আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে চলে যাবে? অথবা বিএনপিকে যদি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে হয়, তাহলে বিএনপির কি আর রাজনীতি করা হবে না?
আওয়ামী লীগের বাক্যবাগীশ সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘আক্রমণ করলে পাল্টা আক্রমণ হবে কি না, সময় বলে দেবে। তবে আমাদের কর্মীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ললিপপ খাবে, এটা মনে করবেন না।’
ললিপপের কথায় জিবে জল এল। আহা, কত দিন ললিপপ চোষা হয় না। আচ্ছা, আমার মতো কৌতূহলী যারা ১০ ডিসেম্বর দূরে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি দেখবে, তাদের কি বিনা মূল্যে ললিপপ সরবরাহ করা যায় না?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা