বইমেলা চলাকালে বাংলাবাজারে এক প্রকাশকের কাছে গিয়েছিলাম স্কুলের লাইব্রেরির জন্য বই কিনতে। আহসান হাবীবের লেখা ‘ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড’ বইটির দাম ২০০ টাকা। প্রকাশককে বললাম, ‘১৫০ কপি কিনব, ৫০ শতাংশ কমিশন দিতে পারবেন?’ প্রকাশক বললেন, ‘৩০ শতাংশের ওপর কমিশন দেওয়া যাবে না। কারণ এটার জন্য লেখককে রয়্যালটি দিতে হয়। তবে ৫০ শতাংশের ওপর কমিশন আছে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের বইয়ে। কারণ ওনাদের রয়্যালটি দিতে হয় না!’
যুক্তি মেনে নিয়ে ৩০ শতাংশ কমিশনে বইটির মূল্য নির্ধারণ হলো ১৪০ টাকা। তখনই বই চাওয়ায় প্রকাশকের মাথায় হাত। বললেন, বই স্টকে নেই। ছাপিয়ে, বাঁধাই করে, শুকিয়ে দিতে তিন-চার দিন লাগবে। কথার এক ফাঁকে প্রকাশককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা ভাই, আমি তো প্রকাশনার জগতে মূর্খ মানুষ, একটা বিষয় নিছক জানার জন্য জিজ্ঞেস করি। আপনি যে নতুন করে ১৫০টি বই ছাপাবেন, এটা কি লেখক জানেন? নতুন বই ছাপার পরে তিনি কি রয়্যালটি পাবেন?’
প্রকাশকের উত্তর হ্যাঁ বোধক হলেও লেখকের চোখের আড়ালে এ রকম অসংখ্য বই ছাপা হয় প্রতিদিন, বিক্রি হয়। বাংলা একাডেমি নির্ধারিত এক মুদ্রণ মানে এক হাজার কপি বই। কেউ কেউ ৩০০-৫০০ কপি ছেপেও মুদ্রণ হিসাব করেন। এখানে একটা ফাঁকি আছে। লেখক জানতে পারেন না তাঁর কতটুকু প্রাপ্য। রয়্যালটি নেওয়ার সময় প্রকৃত বিক্রি বইয়ের সংখ্যা কখনোই কি জানা সম্ভব হয় লেখকের? অনেক প্রকাশক কয়েকজন খ্যাতনামা লেখকের বই প্রকাশের আগেই প্রচুর টাকা রয়্যালটি বাবদ অগ্রিম দিয়ে দেন। সে রকম প্রকাশক ও লেখকের সংখ্যা অতি অল্প। একই প্রকাশক আবার সব লেখকের ব্যাপারে একই রকম উদারতা প্রদর্শন করেন না।
রয়্যালটি না দেওয়ার পেছনে প্রকাশকেরা সচরাচর যে ‘অজুহাত’গুলো দেন এর মধ্যে একটি হলো বই বিক্রি হয়নি, হয় না। নিয়মিত যাঁরা বইমেলায় যান, বই কেনেন তাঁরা লক্ষ করবেন, সমসাময়িক সাহিত্যসচেতন পাঠক ছাড়াও, একশ্রেণির পাঠক মেলায় আসেন, যাঁরা বই কেনেন হাতের কাছে যা পান তা। শিশুতোষ বইয়ের বেলায় এ ঘটনা বেশি ঘটে। বই চলেনি বলে প্রকাশক যাঁদের বঞ্চিত করেন, তাঁদের বইও অনেক বিক্রি হয়। নতুন লেখকদের অনেকে মেলায় আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের এনে প্রকাশকের অনেক বই বিক্রি করে দেন বা পরিচিতরা নিজ দায়িত্বে এসে বই কিনে নিয়ে যান। বছর শেষে লেখককে ১০০ টাকা হলেও রয়্যালটি দেওয়া উচিত। সারা বছর লেখকের এক কপি বইও বিক্রি হয়নি—এমন সম্ভাবনা খুব কম।
হাতে গোনা কয়েকজন প্রকাশক ছাড়া বেশির ভাগ প্রকাশকই লেখকের সঙ্গে চুক্তি করেন না। কী হারে লেখক রয়্যালটি পাবেন, বছরের কোন সময় রয়্যালটি দেওয়া হবে—এসব চুক্তিপত্রে উল্লেখ থাকা উচিত। বই প্রকাশের আগে লেখক-প্রকাশকের চুক্তি না থাকলে রয়্যালটি দিতে প্রকাশক বাধ্য নন এবং লেখকেরও আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ নেই। প্রকাশকের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার স্বার্থে বেশির ভাগ লেখক কোনো অভিযোগ করেন না। চুক্তি না করা, বই বিক্রির সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরি করা ও মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বই প্রকাশের অভিযোগ ওঠার কারণে একবার বইমেলায় স্টল বরাদ্দের ক্ষেত্রে লেখক সম্মানীর প্রমাণপত্র জমা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলা একাডেমি। তবে প্রকাশকদের তোপে বিষয়টি আর এগোয়নি।
বইমেলা শেষে প্রতিবছর বাংলা একাডেমি যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, সেখানে মোট বইয়ের প্রায় ১৫-২০ শতাংশ রয়্যালটির টাকা বলে প্রকাশকেরা তথ্য দেন। হাতে গোনা কিছু নামকরা লেখক ছাড়া কাউকেই এই অর্থ বুঝিয়ে দেন না প্রকাশকেরা। রয়্যালটির বিড়ম্বনা এড়াতে অনেক লেখক নিজেরাই বই প্রকাশ করছেন, অনলাইনে বিক্রি করছেন, চুক্তিভিত্তিক মেলার স্টলে-স্টলে দিচ্ছেন। তবে এটা মূলধারার সংস্কৃতি হতে পারে না।
গত বছর বইমেলা না হওয়ায় এবার বইমেলা ঘিরে বাড়তি আগ্রহ ছিল। করোনার ধাক্কা সামাল দিয়ে মুনাফার মুখ দেখেছেন প্রকাশকেরা। কিন্তু লেখকের কী লাভ! বইকেন্দ্রিক বিশাল এ বাণিজ্যে লেখকেরা প্রাণভোমরা হওয়া সত্ত্বেও বাণিজ্যিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হন তাঁরাই।
সাজিদ মোহন, শিশুসাহিত্যিক