দেশব্যাপী অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুঁজে বের করার অভিযান চলছে। দেশে বছরব্যাপী কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে সরকার অভিযান করেই থাকে। কখনো আবার একই সময়ে একাধিক বিষয় নিয়েও অভিযান চলতে দেখা যায়। তবে এসব অভিযানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কতটা পূরণ হয়ে থাকে, তা সাধারণ মানুষ জানে না। তারা শুধু অভিযান পরিচালিত হতেই দেখে এবং অচিরেই তাদের মনের মধ্যে যে আশার আলো জেগেছিল, তা নিভে যেতে থাকে। বাজারে চালের দাম বেশি; অভিযান চলছে, তেলের দাম বেশি; অভিযান চলছে, পেঁয়াজের দাম বেশি; অভিযান চলছে, নদী দখলমুক্ত করতে অভিযান চলছে, ইটভাটা পরিবেশদূষণ করছে; অভিযান চলছে, সুন্দরবনে বেআইনিভাবে সম্পদ আহরণ করা হচ্ছে; অভিযান চলছে, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসের বকেয়া বিল; আদায়ে অভিযান চলছে, পৌরকর বকেয়া; আদায়ের অভিযান চলছে। প্রতিদিন এমন কত যে অভিযান চলমান, তার তালিকা করাই কঠিন।
এখন যেসব অভিযান চলমান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি হাসপাতালে অভিযান। কিন্তু এতে কি সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার উন্নত ব্যবস্থা হয়ে যাবে? সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, যেসব প্রতিষ্ঠানকে অভিযানে বৈধ বলা হচ্ছে সেগুলোরও সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী বৈধতা আছে কি? সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠান সরকারি হাসপাতালের এক কিলোমিটার বা বিশেষ ক্ষেত্রে ৫০০ মিটারের মধ্যে কোনোভাবেই করা যাবে না। অথচ সাধারণ মানুষ কী দেখছে? সরকারি হাসপাতালের প্রাচীরের পাশ ঘেঁষে রাস্তার ওপারেই লাইন দিয়ে ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বেসরকারি হাসপাতালগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কোনোভাবেই অস্বাভাবিক নয়। চোখ বন্ধ করে অনুমোদন দিলেই যদি বৈধতা পাওয়া যায়, তবে সিলগালা করে দেওয়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধ হতে যাবে কেন?
আমাদের কিশোরকালে যশোর সরকারি হাসপাতালের পাশের রাস্তায় একটা খুব সুন্দর ইমারত নির্মিত করতে দেখেছিলাম। লোকপরম্পরায় শুনেছি, ভদ্রলোক একটা বেসরকারি হাসপাতাল গড়তে এ ভবন নির্মাণ করছেন। পরে অসম্পূর্ণ ভবনটি দীর্ঘদিন পড়ে থাকতে দেখে জেনেছি, সরকারি অনুমতি না পাওয়ার কারণে অভিমানে তিনি এলাকা ত্যাগ করে রাজধানীবাসী হয়েছেন। সেই অসম্পূর্ণ পড়ে থাকা ভবনে আজ বেসরকারি হাসপাতাল হয়েছে, যদিও সময় পার হয়ে গিয়েছে ৫০ বছর। এখন এই ভবনে হাসপাতাল করার অনুমতি কে দিলেন এবং কীভাবে দিলেন, তা জানতে ইচ্ছা করে। সরকারি নীতিমালা শিথিল হয়েছে, এমনটা তো শোনা যায় না। তাহলে সাধারণ মানুষ যদি বিশ্বাস করে সরকারি নীতিমালা প্রয়োগে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আন্তরিক নন, সেটা কি অন্যায় হবে? জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতাহীন একটা প্রশাসন সরকারি হাসপাতালের গেটের সামনে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা রেখে চলেছে! এখন কাদের বিচার আগে প্রয়োজন, সে সিদ্ধান্ত সরকারকেই নিতে হবে।
বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর দেখভাল করার জন্য সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে একটা কমিটি আছে। বাংলাদেশের সমস্যা সর্বত্র একই। জনবলের সংকট নিয়ে সবাই দিনরাত পরিশ্রম করে চলেন। সবাই নিজ দায়িত্ব পালন করতেই হিমশিম খাচ্ছেন সেখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের সময় বা সুযোগ কোথায়? তাই কোনো বিষয় একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে পড়লে তখন বাধ্য হয়ে দুই-এক দিন সে দায়িত্ব পালন করলেও পরে আর তা মনে থাকে না। আর একটা অভিযান পরিচালনা করতে তো বেশ কিছু ব্যক্তির সমন্বয়ের প্রয়োজন পড়ে। এটাও খুব কঠিন কাজ। সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের পরই তো অতিরিক্ত কাজ করবেন। তাই হঠাৎ হঠাৎ কিছু বেয়াড়া মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য অভিযান চলে। তাৎক্ষণিকভাবে জেল-জরিমানা করা হয়, তারপর আবার সবাই চুপ করে যায়। এই অভিযানগুলো আবার ধারাবাহিকভাবে সবার জন্য পরিচালনা করা হয়ে থাকে না। তাতে থলের বিড়াল বের হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রকৃত অর্থে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের অথচ সেখানে জনগণের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা পর্যন্ত গড়ে তোলা সম্ভব না হওয়ায় এসব অভিযান লোকদেখানো বলেই সাধারণ মানুষ মনে করে। যদিও অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যের কথাও অনেকে বলে থাকেন।
দেশের বিত্তবান, ক্ষমতাবান, মধ্যবিত্ত—সবাই নিজ নিজ ক্ষমতানুযায়ী বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা চিকিৎসকদের ওপর ন্যূনতম আস্থা কারও আছে বলে মনে হয় না। তাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী যতই কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করুক না কেন তার পুরোটাই লোকদেখানো। এতে স্বাস্থ্যসেবার কোনো উপকার তো হবে না। শুধু কিছু ব্যক্তির উপকার হবে। অভিযানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যদি স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধিই হতো তাহলে কাগজপত্রের চেয়ে নীতিমালা বাস্তবায়নের ওপরেই অধিক জোর দেওয়া হতো। সাধারণ মানুষকে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থার ওপরই জোর দেওয়া হতো। যাঁরা নিজেরা দেশের স্বাস্থ্যসেবার ওপর আস্থা রাখেন না, তাঁরাই সাধারণ মানুষের জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন—এ কথাটি দেশের অনক্ষর অনাহারী মানুষ বিশ্বাস করতে পারে না। সে কারণে করোনা মহামারিকালেও সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোটিপতির সংখ্যা ঠিকই বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি নীতিমালাকে পাশ কাটিয়ে অবৈধভাবে যার প্রতিষ্ঠা, সেখানে বৈধতার খোঁজ করা প্রতারণার শামিল নয় কি?
কয়েক দিন আগে টেলিভিশনে শুনলাম প্রশ্নকর্তার এক প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসকদের এক নেতা বলছেন, ‘একটা ক্লিনিক বৈধ না অবৈধ তা দেখার দায়িত্ব চিকিৎসকের নয়।’ শতভাগ সত্য কথা। একজন চিকিৎসকের সময় কোথায় এত খোঁজখবর করার। মানবতার সেবা করার দীক্ষা গ্রহণ করেছেন তিনি, যেখানেই ডাক আসে সেখানেই ছুটে যেতে হয়। তাইতো বৈধ-অবৈধ বিবেচনার সময় পান না। তবে দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই জানে ডাক্তারদের ছোটাতে গেলে কী প্রয়োজন পড়ে আবার এটাও সবাই জানে যে অবৈধ জায়গায় খামটাও একটু বেশিই ভারী হয়ে থাকে। আমাদের দেশের চিকিৎসকেরা নিজেদের অবস্থান পাকা করতে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবার জন্য যে টিমওয়ার্কের প্রয়োজন, সে প্রক্রিয়াটাকে পর্যন্ত ধ্বংস করে দিয়েছেন। চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে, সফল করতে, কাঙ্ক্ষিত মানে নিয়ে যেতে টিমের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেই আজকের এ অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। সেবার মান রক্ষায় প্রয়োজনীয় নার্স নেই, সহকারী হিসেবে টেকনিশিয়ান নেই, প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সাধারণ ডাক্তারও নেই। সবকিছুর জন্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই একমাত্র ভরসা। এলএমএফ কোর্সকে অনেক আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষও ইতিমধ্যেই চিকিৎসাসেবার আওতার বাইরে বেরিয়ে গেছে।
আমাদের দেশের বিপুল জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য বেসরকারি উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে বেসরকারি উদ্যোগের জন্য সুষ্ঠু ও সুন্দর নীতিমালা প্রয়োজন, যা কঠোরভাবে মেনে চলতে বাধ্য করার পরিবেশও সৃষ্টি করতে হবে। নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। হঠাৎ হঠাৎ অভিযান পরিচালনা করে, দায়িত্ববান ব্যক্তিরা আস্ফালন করলে কোনো লাভ হবে না। সুষ্ঠু পরিকল্পনাই মুক্তির একমাত্র পথ। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে টিম তৈরির মানবসম্পদ পরিকল্পনা জরুরি। দুজন নার্সের বিপরীতে একজন চিকিৎসকের অনুপাত দিয়ে আর যাই হোক সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। টেকনিশিয়ানদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান নিশ্চিত করে তারপরই বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিচালিত অভিযান ফলপ্রসূ হতে পারে। অন্যথায় দেশব্যাপী পরিচালিত অভিযানের মতো বর্তমানের অভিযানও একই পথে হাঁটবে।