হোম > ছাপা সংস্করণ

খেলা হবে, নূর হোসেন কোথায়?

মামুনুর রশীদ

সম্প্রতি খেলা হবে বলে একটি রব উঠেছে। সরকারি দল বলছে খেলা হবে, বিরোধী দলও বলছে খেলা হবে। একদা দুই দল মিলেই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে খেলেছিল। খেলে স্বৈরাচারকে পরাজিতও করেছিল। সেই খেলায় জীবন দিয়েছিল তরুণ নূর হোসেন। তাঁর শরীরের রক্ত দিয়েই লিখে গিয়েছেন ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। এই যে দল দুটি বলছে খেলা হবে, এর অর্থ কী?

খেলা হবে, শক্তি প্রদর্শন হবে, মানুষের ভোগান্তি হবে, দুই দলই ক্ষতবিক্ষত হবে। গণতন্ত্রের প্রতিভূ সংসদ অকার্যকর থাকবে। আর স্বৈরাচার নিপাত না হয়ে দলটি গৃহপালিত বিরোধী দল হয়ে সংসদে বহুদিন ধরে অবস্থান করছে। সেই দলেই থেকে থেকে খেলা চলছে। মূলত এই ‘খেলা হবে’ রবটি উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলাকে স্বশাসিত করার জন্য নির্বাচনী প্রচারণার একটা আওয়াজ। সেখানে খেলা শেষ হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের কর্তৃত্ব রক্ষা করতে পেরেছে। যে স্লোগানটি রাজ্যের বিষয়, তাকে বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রের মধ্যে টেনে আনা কি সুবিবেচনার কাজ?

ওখানে খেলা হলে রাজ্য, রাষ্ট্র এবং আন্তরাজ্য সমীকরণে জনগণ স্বস্তি পায়। কিন্তু এখানে? সবকিছুর ওপর প্রভাব পড়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর চাপ পড়ে, যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিতে। এই পরিস্থিতির সম্পূর্ণ সুযোগ নেন ব্যবসায়ীরা। এই স্বাধীন ব্যবসায়ীদের ওপর কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সহিষ্ণু জনগণের নেই, সরকারের নেই, এমনকি তাঁদের সর্বোচ্চ সংগঠন এফবিসিসিআইয়েরও নেই।

আরও বড় বিষয় হচ্ছে দুর্নীতি। একচেটিয়া ক্ষমতা সব সময়ই দুর্নীতি ডেকে আনে। সরকারি অফিস-আদালতে ঘুষ নেওয়া একটা প্রকাশ্য বিষয়। ন্যায্য কোনো কিছু হওয়ার উপায় নেই। টাকা দিতেই হবে। খেলায় অংশগ্রহণকারী দুটি দল কি দুর্নীতির বিষয়ে কিছু বলছে? বিরোধী দলের একটাই কথা, রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবে। গিয়ে কী করবে? সর্বব্যাপী দুর্নীতি কি রোধ করতে পারবে? তার জন্য কি কোনো রোডম্যাপ আছে? বললে বিপদও আছে। কর্মীরা মাঠ থেকে চলে যাবে। দুই দলের মধ্যে একই সংকট। তাহলে খেলাটা কি টাকার?

নূর হোসেন আজকের দিনে প্রাণ দিয়েছিলেন একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য। একধরনের গণতন্ত্র এসেও ছিল, কিন্তু আবারও তার মীমাংসা করতে হচ্ছে রাজপথে। এত রক্তের বিনিময়ে লাল-সবুজের পতাকাশোভিত সংসদটা মীমাংসার ক্ষেত্র হতে পারল না। যেসব দেশে গণতন্ত্র আছে, সেখানে সংসদই কুরুক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায় (অবশ্য ট্রাম্প যেভাবে সংসদ আক্রমণ করে ফেললেন, তা একটা বড় ঘটনা), বিচার বিভাগ শক্ত হাতে আইনের প্রতিষ্ঠা করে এবং সর্বোপরি জননিরাপত্তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। সরকার ক্রমেই গৌণ হয়ে দাঁড়ায় গণজীবনে। কিন্তু যেখানে গণতন্ত্রচর্চা অনুপস্থিত থাকে, সেখানে খেলাই চলে। খেলার শেষ হয় না; বরং নতুন নতুন খেলার জন্ম নেয়। রাজপথ থেকে গড়িয়ে যায় রাজনৈতিক দলের সংগঠন, তারপর যেকোনো সংগঠনের কর্মকাণ্ডে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সরকারি-বেসরকারি অফিসে এবং সবশেষে পরিবারে। খেলার শিষ্টাচার আর থাকে না।

রেফারি অসহায় এবং শেষ পর্যন্ত বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশটায় একদা যে সমাজ বলে একটা কথা ছিল, তা-ও আমরা বিস্মৃত হয়ে যাই। কিন্তু যে সমাজে শিল্পবিপ্লব ঘটেনি, সেখানে তো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদও আসেনি। সামাজিক শাসনে আমরা তো ভালোই ছিলাম, নিরাপদে ছিলাম কিন্তু সংকটটা ছিল একটা জায়গায়—শোষণ। প্রাচীন সমাজ সেটা থেকে মুক্তি দিতে পারেনি। এ জন্যই পৃথিবীতে একটা নতুন মতবাদ এসেছিল, যার নাম সমাজতন্ত্র। মানুষ সামাজিক অনুশাসন মানবে কিন্তু শোষণ থাকবে না, থাকবে সাম্য। কিছু কিছু রাষ্ট্র নির্মাণও হলো। শোষণ থাকল না। কিন্তু নেতৃত্ব লাগে সব জায়গায়। আবার নেতৃত্বের লাগে ক্ষমতা। এই ক্ষমতার অপব্যবহারই ডেকে আনে আরেক খেলা—শুরু হয় শোষণ, নির্যাতন, পরমত অবদমন। তাই সেই সব রাষ্ট্রেও ভাঙন আসে একসময়। কিন্তু ভেঙেই-বা কী লাভ হলো? রাশিয়া ভাঙল, পুঁজিবাদ এল। কিন্তু রাশিয়ার প্রতিবেশী ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এমনই এক যুদ্ধ, যা পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে তার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে যাচ্ছে। এখন তো নব্য পুঁজিবাদী রাশিয়ার সঙ্গে শুধু নব্য পুঁজিবাদী ইউক্রেনের নয়, সারা পৃথিবীর পুঁজিবাদেরই লড়াই। এ লড়াই থামার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তার মানে দাঁড়ায়, খেলা হবে! এই খেলায় মানুষ মরবে, পৃথিবীর সম্পদ ধ্বংস হবে। বায়ুমণ্ডলটা এমনভাবে কলুষিত হবে যে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের জায়গাটা কমে আসবে।

ওখানে কতটা খেলা হচ্ছে? তার কয়েক গুণ খেলা হচ্ছে আমাদের দেশে। কিন্তু এ খেলা মারণাস্ত্রের খেলা নয়, রাজনৈতিক নেতা, আমলা, ব্যবসায়ীদের খেলা। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তদের অস্ত্র দিয়ে মারতে হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের চাপ, পরিবহন ব্যয়, চিকিৎসা ব্যয়—জীবন ধারণের সব ক্ষেত্রেই প্রভাব পড়েছে এই যুদ্ধের থাবা। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে খেলা। খেলাই যদি হবে, তাহলে লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ দিলেন কেন? গণতন্ত্রের জন্য এভাবে বুক চিতিয়ে জেনেশুনে আত্মাহুতি দিলেন কেন নূর হোসেন? 
নূর হোসেন প্রাণ দিয়েছেন মিছিলে। যেকোনো আন্দোলনে, সংগ্রামে মানুষ যেভাবে প্রাণ দেয়, সেভাবেই দেখা হয়েছে তাঁর মৃত্যুকে। তাঁর মৃত্যু আসলে আমাদের গণতন্ত্রচর্চায় কোনো গুরুত্ব পায়নি। কারণ, নূর হোসেন সর্বহারা। দরিদ্র পরিবারের নামগোত্রহীন নূর হোসেনের জীবনটা মূল্যবান ছিল না। কিন্তু তাঁর শরীরের ভাষা এবং লেখা যে সে সময়ের পুরো রাজনীতিকেই ধারণ করেছিল, তা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। যাঁরা ক্ষমতার লড়াইটায় ছিলেন, তাঁরা বুঝতে পেরে শঙ্কিতও হয়েছিলেন কিছুটা। কোনো নতুন শক্তির পদধ্বনি কি শুনতে পেয়েছিলেন?

মুক্তিযুদ্ধেও নূর হোসেনের মতো অনেক তরুণ গান গাইতে গাইতে এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁদের সেই আত্মত্যাগের কথা আমরা বিস্মৃত হয়েছি এবং খেলায় মেতে উঠেছি। এ খেলা ভয়ংকর, এ খেলা আত্মঘাতী। কিন্তু এ খেলা সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। সোজা ভাষায় এ দুর্দমনীয় এক ক্ষমতার খেলা। পুঁজিপতি দেশে এসব খেলায় সমঝোতা হয়। আমাদের দেশে হয় না। তাই গণতন্ত্রটাও আসে না। নূর হোসেনের এভাবে প্রাণ দেওয়াটা নিয়ে আজ তাহলে কী ভাবব?

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ