অর্থ পাচার নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা, বিভিন্ন মাধ্যম, বিভিন্ন রকম তথ্য দিয়ে থাকে। কোনো কোনো মাধ্যম বলেছে, বছরে গড়ে ৬৮ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। সংবাদমাধ্যমে এমন খবর এসেছে—গত পাঁচ বছরে ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এসব কথার মূল ভিত্তি আছে কি না, সে সম্পর্কে সঠিকভাবে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারছে না। এসব ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার। কারণ এ কাজটি যাঁরা করেন, তাঁরা সমাজের উঁচুতলার মানুষ, বিত্তশালী তো বটেই; তার ওপর তাঁদের হাতে অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণের ভার থাকে। তাই এই অর্থ পাচারের ব্যাপারে সবকিছু বিশ্বাস করা যেমন সঠিক নয়, আবার অর্থ পাচার যে হচ্ছে না, সেটাও বলা যাবে না। আমি এখানে টাকার অঙ্ক নিয়ে কোনো পরিসংখ্যান দিতে চাই না। তবে অর্থ পাচার হচ্ছে। কেমন করে সেটা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, সে জন্য প্রথমে যে কাজটি করতে হবে, সে সম্পর্কে আলোকপাত করব।
অনেকভাবেই অর্থ পাচার হতে পারে। তবে প্রাথমিকভাবে বেশি পরিমাণে টাকা পাচার হয় যেভাবে, সেটা হলো আমদানি পণ্যের অধিক মূল্য ঘোষণা। ইংরেজিতে বলে ‘ওভার ইনভয়েসিং’। এই ওভার ইনভয়েসিং সব ক্ষেত্রে হয় না। কিছু কিছু পণ্য, যেসব পণ্যের আমদানি শুল্কহার শূন্য বা শূন্যের কাছাকাছি, সেই সব ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং হয়ে থাকে।
শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য আমদানি করা হয় ক্যাপিটাল মেশিনারি এবং এই শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল। শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য যে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি করা হয়, তার বেশির ভাগই আমদানি হয় ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া অর্থের মাধ্যমে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই সব পণ্যের ওপর কোনো কাস্টম ডিউটি ও ভ্যাট-ট্যাক্স থাকে না। তাই এটি অর্থ পাচারের একটি সহজ মাধ্যম।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অবস্থিত কাস্টমস কর্তৃপক্ষ প্রায় ক্ষেত্রেই পণ্যের মূল্যায়নের ব্যাপারে কোনো রকম পরীক্ষা করে না। বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মাধ্যমে এসব ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। এসব পণ্যের শুল্ক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ‘ভ্যালুয়েশন মেথড’ অনুসারে পণ্যের মূল্যায়ন যাচাই-বাছাই করা হয় না। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ মনে করে যেহেতু সরকারের রাজস্ব এখানে যুক্ত নয়, তাই এটিকে তারা খুব হালকাভাবে নেয়।
এখানে যদি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ অর্থ পাচারের বিষয়টি মাথায় রেখে এসব ক্যাপিটাল মেশিনারি বা রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামালের মূল্য যাচাই-বাছাই করত, তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অর্থ পাচার রোধ করা যেত।
এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, সত্তরের দশকের শেষের দিকে এই মুদ্রা পাচার বন্ধের জন্য নাইজেরিয়া প্রিশিপমেন্ট ইন্সপেকশন পদ্ধতি (পিএসআই) চালু করেছিল। মুদ্রা পাচার কিছুটা হলেও রোহিত হয়েছিল সেই সময়। অবশ্য আমাদের দেশে পিএসআই সিস্টেম ছিল ২০০০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত। সরকারের কাস্টমস রেভিনিউ প্রোটেকশন দেওয়ার জন্য। এই পদ্ধতি এখন আর নেই।
অবশ্য এখন আমদানি পণ্যের মূল্য শুল্কায়নের জন্য গ্যাট ভ্যালুয়েশন পদ্ধতি দেশে চালু আছে। এই পদ্ধতি অবলম্বন করে সরকারের রাজস্ব আহরণ করা হয়। এই পদ্ধতিতে রাজস্ব আহরণ যথেষ্ট শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে যদি এখন শতভাগ রপ্তানিমুখী পণ্যের ও যেসব পণ্যের শুল্কহার শূন্য অথবা তার কাছাকাছি, এসব পণ্যের মূল্যায়নের ব্যাপারে সঠিকভাবে গ্যাট ভ্যালুয়েশন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তাহলে অর্থ পাচার অনেকাংশে রোধ হবে।
এ ক্ষেত্রে দুটি সংস্থাকে তৎপর হতে হবে–জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংক। যেহেতু শতভাগ রপ্তানিমুখী অথবা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নামে লোন নেওয়া হয় ব্যাংক থেকে, তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা দায়বদ্ধতা আছে।
পোশাক কারখানার পণ্যের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে ও ফিনিশড গুডস রপ্তানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং হয়ে থাকে। তাই এসব ক্ষেত্রেও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে পণ্যের শুল্কায়নের ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে।
আব্দুর রাজ্জাক, প্রকৌশলী