রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পে কাদম্বিনী দেবী মরে গিয়ে প্রমাণ করেছিলেন তিনি মরেননি। নিজের অস্তিত্ব প্রমাণে প্রতিবাদ হিসেবে তাঁকে দেহত্যাগ করতে হয়েছিল। বেন স্টোকস প্রতিবাদটা করেছেন একটু ভিন্নভাবে। ওয়ানডে থেকে আকস্মিক বিদায়ের ঘোষণায় বোঝাতে চেয়েছেন, ঠাসা সূচির ‘দমবন্ধ ক্রিকেট’ তাঁর পছন্দ নয়।
নিউজিল্যান্ড ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে আসার পর ডারহামকে বানিয়েছিলেন নতুন ‘ঘর’। তিন দিন আগে সেই ডারহামের মাঠ চেস্টার লি স্ট্রিটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাঠে নামার সময় বিদায়ের করতালি শুনেছেন ২০১৯ বিশ্বকাপ জয়ের মহানায়ক স্টোকস। বয়স ৩১, চাইলে অনায়াসে আরও কয়েক বছর ওয়ানডে খেলা চালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু আইসিসির ২০২৩-২৭ সাল পর্যন্ত ভবিষ্যৎ সফর পরিকল্পনা (এফটিপি) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের পরই স্টোকসের অবসর নেওয়াকে কেন্দ্র করে আলোচনা-সমালোচনার শুরু। ব্যস্ত সূচি নিয়ে তাঁর মন্তব্যই বলে দেয় কতটা হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি, ‘অতিমাত্রায় ক্রিকেট চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঠাসা সূচিতে তিন সংস্করণ চালিয়ে যাওয়া ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ছিল। আমরা গাড়ি নই যে জ্বালানি ভরিয়ে চলতেই থাকব।’
আগামী চার বছরের সূচিতে সর্বোচ্চ ৪২টি টেস্ট খেলবে ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪১ টেস্ট খেলবে অস্ট্রেলিয়া। এ বছরের জুনে আন্তর্জাতিক মৌসুম শুরু হয় ইংলিশদের। শেষ হবে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে। এ সময়ে তিন সংস্করণ মিলিয়ে ২৩ ম্যাচ খেলবে তারা। আগামী এক বছরে ঘরে-বাইরে মিলিয়ে খেলায় ব্যস্ত থাকতে হবে ১০০ দিনেরও বেশি। এ ছাড়া কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ, রয়্যাল লন্ডন ওয়ানডে কাপ, ভাইটালিটি টি-২০ ব্লাস্ট, দ্য হানড্রেডের মতো ঘরোয়া টুর্নামেন্ট তো আছেই। সঙ্গে আছে আইপিএলসহ বিভিন্ন দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ।
চাপ শুধু স্টোকসের একার নয়, আন্তর্জাতিক ও ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট প্রায় সব খেলোয়াড়ের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেড়ে নিচ্ছে। ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৫০০ দিনের কাছাকাছি ক্রিকেট সূচি ছিল ইংল্যান্ডের। দুইয়ে থাকা ভারতের ৪৭২ দিন। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিসিআই) সাত মাসে সাতজনকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়ার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হয়েছে ঠাসা সূচির কারণেই।
সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক নাসের হুসেইন তো আর এমনি এমনি ঠাসা সূচিকে ‘পাগলামি’ বলেননি! তবে এত আলোচনা-সমালোচনা পরও ক্রিকেটারদের নিস্তার মিলছে না। প্রতিটি দেশের ক্রিকেট বোর্ডই যে আইসিসির ‘লাভের গুড়’ খেতে ও করপোরেট জগতে মিশে যেতে ব্যস্ত।
ওয়ানডে থেকে স্টোকসের আকস্মিক বিদায় ক্রিকেট প্রশাসকদের নিশ্চিতভাবে জাগরণের বার্তা দিয়েছে, চোস্ত এক জবাবও দিয়েছে বটে। সেটা করতে গিয়ে ক্রিকেটের একটি সংস্করণ যে ‘ব্যাড বয়’ থেকে ‘ক্রাইসিস ম্যান’ হয়ে ওঠা একজনকে হারিয়েছে, সে দায়ভার কে নেবে?