রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। শুরুতে হুমকি-ধমকি এবং বড় অস্ত্রবহর নিয়ে কিয়েভমুখী হয়ে হুংকার ছোড়ে রাশিয়া। কিন্তু পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট জেলেনস্কি সরকার একটুও টলেনি নিজেদের অবস্থান থেকে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে আসা ভারী অস্ত্র দিয়ে রাশিয়াকে পাল্টা জবাব দিতে থাকে তারা। পিছু হটতে বাধ্য হয় রুশ সৈন্যরা। একসময় রাশিয়া কৌশল পরিবর্তন করে ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণের অঞ্চলগুলোতে সামরিক অভিযান চালায়। এতে বেশ সফলতাও আসে। তবে রাশিয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জেলেনস্কি সরকারের পতন এবং যুদ্ধে জিতে পশ্চিমাদের একটা বড় শিক্ষা দেওয়া। যুদ্ধের ছয় মাস পেরিয়েও গেলেও সুরাহা হয়নি কোনো কিছুর। আগামী দিনেও কি কোনো চূড়ান্ত ফল দেখতে পারবে বিশ্ব? কোন দিকে মোড় নেবে যুদ্ধের গতিপথ?
১. যুদ্ধ আরও এক বছর চলবে কিন্তু অচলাবস্থা ও যুদ্ধের তীব্রতা কমতে থাকবে
যুদ্ধের ছয় মাস পেরিয়ে গেছে কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেনের কেউই হাল ছাড়তে নারাজ। ইউক্রেন চায় দখল হওয়া অঞ্চল ফিরে পেতে, অন্যদিকে রাশিয়া ইউক্রেনের মাধ্যমে পশ্চিমাদের বড় শিক্ষা দিতে চায়। সামনের শীতকাল পুতিনের জন্য একটা বড় সুযোগ।
বুচা, ইরপিন ও রাশিয়ার অধিকৃত অন্যান্য অঞ্চলে গণহত্যার প্রমাণ পাওয়ার পর থেকে দুই পক্ষের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। জুনের শেষে লাইসিচানস্কের পতনের পর সম্মুখযুদ্ধের গতি কমে গেছে। দুই পক্ষের সৈন্যরা ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত।
২. পাল্টা আক্রমণের রসদ নেই, তবে গেরিলা আক্রমণের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার পতন চায় ইউক্রেন
ইউক্রেন খেরসন পুনরুদ্ধার করতে চায়। কিন্তু ইউক্রেন প্রশাসনের একজন সিনিয়র ব্যক্তি স্বীকার করেন তাঁদের কাছে দখল অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য পর্যাপ্ত রসদ নেই। দূরপাল্লার অস্ত্র এবং রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটিতে ঢুকে গোপনে হামলা চালানোই এখন ইউক্রেনের নতুন কৌশল।
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পোডোলিয়াক বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাশিয়ান বাহিনীর মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করা।’
এভাবে হয়তো রুশ বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে কিন্তু এর মাধ্যমে পতন আশা করা নিতান্ত বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
৩. রাশিয়া আরও অঞ্চল নিজেদের দখলে নিতে চায় কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্য ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল দখল করেছে, সেগুলো ধরে রাখা এবং ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা
বিশাল কামান দিয়ে শহর-নগর ধ্বংস করে সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া রাশিয়ার নতুন কোনো পরিকল্পনা নেই। কিছু পশ্চিমা বিশ্লেষকের মতে, ক্ষতি ও হতাহতের পরিমাণ কমাতে এই কৌশল বেশ কার্যকর। তাদের ধারণা যুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার রুশ সৈন্য মারা গেছে। দনবাসের বাখমুতে এই কৌশল অবলম্বন করছে রুশ সৈন্যরা। তবে অগ্রগতি খুব সামান্য। মূল কারণ হচ্ছে, এই অঞ্চল থেকে অনেক সেনা পাঠানো হয়েছে খেরসন রক্ষার জন্য।
যুদ্ধের শুরুতে ক্রেমলিন ভেবেছিল খুব সহজেই তারা লক্ষ্য অর্জন করতে সফল হবে, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তবে ধীরে ধীরে রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণের অনেক বিশাল অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। এখন রাশিয়া চাইছে এসব দখল অঞ্চলে গণভোট করে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করে নিতে। সামনের শীতেই কাজটি সেরে ফেলতে চায় রাশিয়া।
৪. শীতে ইউরোপজুড়ে শরণার্থী সংকট দেখা দেবে
শীত নিয়ে দুই দেশের পৃথক কৌশলগত চিন্তাভাবনা আছে। দনেৎস্ক এবং অন্যান্য সম্মুখ এলাকায় ঘরবাড়ি উষ্ণ করার জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস হিটারের ব্যবস্থা নেই। এ নিয়ে ইউক্রেন বেশ উদ্বিগ্ন। মানবাধিকারকর্মীদের মতে, এই শীতে ইউরোপে অভিবাসীদের ঢল নামতে পারে। এর মধ্যে প্রায় ২০ লাখ মানুষ পাড়ি জমাতে পারে পার্শ্ববর্তী দেশ পোল্যান্ডে।
রাশিয়ার জন্য শীত যেন আশীর্বাদ। ইউক্রেনের আশঙ্কা রাশিয়া তাদের পাওয়ার গ্রিডে হামলা চালাবে এবং জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেবে।
যার ফলে শীতে ঘরবাড়ি গরম করাটা আরও দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে। আবার রাশিয়া চায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে পশ্চিমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে। শীতে গ্যাসের চাহিদা বাড়বে, সঙ্গে বাড়বে দামও। আর এই সুযোগটাই নেবে রাশিয়া।
বসন্তে আবার তীব্র যুদ্ধ শুরু হতে পারে। দুই দেশই সম্মুখযুদ্ধে নিজেদের গুছিয়ে নেবে বসন্তের আগেই।
৫. পশ্চিমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কী চায়পশ্চিমা সহায়তা ছাড়া ইউক্রেনের পক্ষে টিকে থাকা দুঃসাধ্য ছিল। দেশটিতে পর্যাপ্ত কামান বা অন্যান্য অস্ত্রের পাশাপাশি যুদ্ধবিমান সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ। যার ফলে যুদ্ধের মাঠে এখনো টিকে আছে ইউক্রেন। পশ্চিমা রাজনীতিবিদেরা রাশিয়াকে পরাজিত করার বুলি আওড়ালেও পর্যাপ্ত অস্ত্র-বারুদ পাঠাতে নারাজ। বিশেষ করে ফ্রান্স ও জার্মানি।
একই সময়ে ইউক্রেনে মানবিক সংকট প্রকট রূপ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধ্বংস হওয়া ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণের জন্য কারও কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। রুশ বাহিনী চলে যাওয়ার পাঁচ মাস পরও কিয়েভের উত্তর-পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিমের বাড়িগুলো পড়ে আছে ধ্বংসস্তূপের মতো। শুরু হয়নি পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়া। মানুষজন বাস করছে গ্যারেজে কিংবা অস্থায়ী কাঠামোতে।
অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের থাকতে হয় স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনে। এসব জায়গা দীর্ঘদিন বাস করার উপযোগী নয়।
যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের বাজেট ঘাটতি প্রতি মাসে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার। পুনর্গঠন ও সাহায্যের জন্য প্রয়োজন এর থেকে আরও অনেক গুণ অর্থ।
(গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর করেন মোশারফ হোসেন)