অশোক মিত্র তখন দিল্লিতে থাকেন। অর্থ মন্ত্রণালয় আর পরিকল্পনা কমিশনে গিয়ে আড্ডা দেন। তর্ক করেন। সকাল–বিকেল কমিউনিস্ট বন্ধুদের সঙ্গেও জমে আড্ডা। তবে ছুঁতো পেলেই চলে যান কলকাতায়। বুদ্ধদেব বসুর তখন মার্কিন মুগ্ধতা চলছে। বামপন্থী অবস্থান থেকে তাঁর সঙ্গে তর্ক চালান অশোক। বুদ্ধদেব অশোকের গদ্যের তারিফ করেন।
কলকাতায় এলে জীবনানন্দ দাশের সঙ্গেও দেখা হয়ে যেত অশোক মিত্রের। কিন্তু অশোক মিত্র টের পেলেন দিনে দিনে জীবনানন্দ দাশ উদ্ভ্রান্ত, আত্মবিশ্বাসরহিত হয়ে যাচ্ছেন। আশপাশে তাঁর বন্ধুরা তখন সচ্ছলতার মুখ দেখছেন। শুধু তিনিই ভদ্রগোছের কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারছেন না। পরিচিতদের ধরছেন, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। তাঁর অনুরাগীরাও চেষ্টা করছেন, কিন্তু কিছু হচ্ছে না।
এক বর্ষার দিন। বৃষ্টি ঝরছে। রাসবিহারী অ্যাভিনিউর ল্যান্সডাউন রোডে ছিল জীবনানন্দ দাশের বাড়ি। সে বাড়িতে ঢুকছেন অশোক মিত্র।
হঠাৎ অশোক মিত্রকে টেনে নিয়ে এক নিমগাছের নিচে দাঁড় করালেন জীবনানন্দ। তারপর কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘আচ্ছা, আপনি কি জানেন, বুদ্ধদেব বাবুর নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকার ফিক্সড ডিপোজিট আছে?’
বুদ্ধদেব বসুর আর্থিক অবস্থা তখন শোচনীয়। এ ধরনের অলীক কথা কে বলল আর তা বিশ্বাস করে নিলেন জীবনানন্দ, সেটা সত্যিই বিস্ময়কর। জীবনানন্দ হয়তো তখন ভাবছিলেন, যেখানে তিনি কখনোই পৌঁছাতে পারবেন না, সেখানে কীভাবে বন্ধুরা পৌঁছে যাচ্ছে! সে সময়ের হিসাবে পঞ্চাশ হাজার বিশাল টাকা। এ রকম সঞ্চয় বুদ্ধদেবের থাকতেই পারে না, সে কথা জীবনানন্দের মনে একবারও এল না।
এর কয়েক মাস পরই ঘটেছিল সেই ভয়ংকর ট্রাম দুর্ঘটনা। তাঁর চকিত চাহনি, সতর্ক-ঘাবড়ানো-অতর্কিত পদক্ষেপ দেখে বন্ধুদের অনেকের মনেই একধরনের আশঙ্কা জেগে উঠছিল। জীবনানন্দেরই পঙ্ক্তি ছিল, ‘সতত সতর্ক থেকে তবু/কেউ যেন ভয়াবহভাবে পড়ে গেছে জলে।’
জলে না পড়ে জীবনানন্দ স্বয়ং পড়লেন ট্রামের নিচে।
সূত্র: অশোক মিত্র, আপিলা চাপিলা, পৃষ্ঠা ১০৩-১০৪