গত দুই দশকে দেশের নিজস্ব গ্যাসসম্পদ সম্পর্কে দুটি বক্তব্য খুব সস্তা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর প্রথমটি হচ্ছে, ‘দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে’। আর দ্বিতীয়টি, ‘দেশে গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে এসেছে’।
প্রথম উক্তিটি করেছিলেন ২০০১-০২ সালে, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। নিরেট বিচারে এটি হয়তো অতিশয়োক্তি। তা ছাড়া, তখন গ্যাস রপ্তানির একটি প্রসঙ্গও ছিল। ফলে উক্তিটি বেশ সমালোচিতও হয়ে আসছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, অর্থমন্ত্রীর মতো দায়িত্বশীল রাষ্ট্রীয় পদে থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য ছাড়া সাধারণত এ রকম উক্তি করেন না। তাহলে কী তথ্য ছিল তাঁর কাছে?
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ করা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) এবং আমাদের পেট্রোবাংলার যৌথ উদ্যোগে করা একটি সমীক্ষার কথা। যাতে বলা হয়, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ সম্ভাবনায় অনাবিষ্কৃত গ্যাস মজুত ৩২ দশমিক ৫ টিসিএফ। এর মধ্যে ৮ দশমিক ৫ টিসিএফ পাওয়ার সম্ভাবনা ৯৫ শতাংশ।
দ্বিতীয়ত, নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেট এবং আমাদের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কারিগরি সংস্থা হাইড্রোকার্বন ইউনিটের যৌথ সমীক্ষায় ৫০ শতাংশ সম্ভাবনায় অনাবিষ্কৃত গ্যাস মজুত বলা হয়েছে ৪২ টিসিএফ। আর ৯০ শতাংশ সম্ভাবনায় পাওয়ার কথা বলা হয়েছে ১৮ দশমিক ৫ টিসিএফ। মনে রাখতে হবে এই সম্ভাবনাগুলোর মধ্যে ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত এবং সমুদ্রবক্ষকে ধরা হয়নি।
এই তথ্যগুলো যখন সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়, তত দিনে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রও উন্নয়ন হয়ে গেছে। সেটি দেশের বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্র হবে বলে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে সাইফুর রহমানের উক্তিটি একেবারে হাওয়া থেকে যে আসেনি, তা বুঝতে সমস্যা হয় না।
কিন্তু কথা হলো গ্যাসের মজুত থাকলেই তো হবে না। অনুসন্ধান করে তা বের করতে হবে। সে কাজটি আমরা কতটা করেছি! আমাদের জ্বালানি খাত মহাপরিকল্পনায় প্রতিবছর অন্তত দুটি অনুসন্ধান কূপ খনন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ২০ বছরে করা হয়েছে ২৬টি। তাহলে গ্যাস আসবে কোথা থেকে?
অধ্যাপক বদরূল ইমাম প্রায়ই একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করেন যে ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সাকল্যে কূপ খনন করা হয়েছে ১১০টির মতো। আর আমাদের প্রতিবেশী ভারতের মাত্র ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ত্রিপুরায় খনন করা হয়েছে ১৫০টির বেশি। কূপ খনন না করলে মাটির নিচের গ্যাস তো এসে আমাদের শিল্পে কিংবা রান্নাঘরে ঢুকবে না!
বেশি করে অনুসন্ধান এবং কূপ খননের বিষয়ে টাকার অভাবের কথা বলা হয়। একটি কূপ খনন করে গ্যাস না পেলে প্রায় ১০০ কোটি টাকা গচ্চা যায়। কিন্তু একটি কূপে গ্যাস পেলে তো আবার ৭০০ শতাংশ মুনাফা হয়। অন্য অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের তুলনায় গ্যাস অনুসন্ধান বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তা ছাড়া, গ্যাস অনুসন্ধানের অর্থ সংস্থানের জন্য ২০০৮-০৯ সালে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ‘গ্যাস উন্নয়ন তহবিল’ নামে পৃথক একটি তহবিল গঠন করে রেখেছে। সেখানে গ্রাহকের অর্থ থেকে কিছু কিছু জমা হয়। সেই তহবিল শুধু গ্যাস অনুসন্ধানে ব্যয় করার কথা। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। সেই অর্থ বিভিন্ন কোম্পানির কাছে সুদে খাটানো হচ্ছে।
নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়ে সরকারি নীতিনির্ধারকদের অনেকে ইউএসজিএস কিংবা নরওয়ের উপরিউক্ত সমীক্ষাগুলোকে অনির্ভরযোগ্য বলে থাকেন। কিন্তু তাঁরাই আবার সরকারের বিদ্যুৎ খাত মহাপরিকল্পনায় (২০১৬) উল্লেখ করেছেন, ‘ইউএসজিএস-পেট্রোবাংলার সমীক্ষা (২০০১) একটি যথার্থ পদ্ধতিগত ও নিবিড় সমীক্ষা। এটি সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে একটি উত্তম কাজ। এর ভিত্তিতে দেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদ আহরণ শুরু করা যায়।’
এবার আসি, গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে। এ বিষয়ের শুরুতে কয়েকটি পরিসংখ্যান উল্লেখযোগ্য।২০১৭ সালে গুস্তাভসন অ্যাসোসিয়েটস নামে একটি ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সরকার এক সমীক্ষা করিয়েছিল। তাদের সমীক্ষা প্রতিবেদনে ৯২ শতাংশ সম্ভাবনায় ৩৪ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। আরেকটি ইউরোপীয় তেল-গ্যাস পরামর্শক প্রতিষ্ঠান র্যাম্বল বলেছে ৩৪ টিসিএফ সম্ভাবনার কথা।
ফরাসি প্রতিষ্ঠান স্লামবার্জার বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর বিষয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাতে বলা হয়, বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলোর পুরোনো কূপগুলোয় কিছু সংস্কারকাজ করে সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্যে দৈনিক ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো যায়।
অতিসম্প্রতি নরওয়েভিত্তিক বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি ইকুইনরের (সাবেক স্টেট অয়েল) সঙ্গে বাংলাদেশ মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি একটি গবেষণা করেছে প্রধানমন্ত্রীর গবেষণা তহবিলের অর্থায়নে। এর ফলাফল হচ্ছে, উত্তোলন বন্ধ করে রাখা ৩০টি কূপে এখনো প্রচুর গ্যাস মজুত আছে, যা সেকেন্ডারি রিকভারি প্রযুক্তির মাধ্যমে তোলা সম্ভব। তাতে এই ৩০টি কূপ থেকে দৈনিক ১ হাজার মিলিয়ন বা ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে গ্যাসের ঘাটতিও এই পরিমাণই।
বেঙ্গল বেসিনের সম্ভাবনার কথা আগেই বলা হয়েছে। সুরমা বেসিনেও অনেক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র পড়ে আছে। এর মধ্যে ছাতক একটি ‘টিসিএফ ফিল্ড’ হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস। জকিগঞ্জ, আবিষ্কৃত ক্ষেত্র কিন্তু গ্যাস তোলা হচ্ছে না। সুনেত্র, নির্ধারিত গভীরতায় খনন করলে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। বিদ্যমান একাধিক ক্ষেত্রে গভীরতর কূপ খনন করে (ডিপার জোন এক্সপ্লোরেশন, ৫ হাজার মিটার+) প্রচুর গ্যাস পাওয়া যাবে। সমুদ্রবক্ষের সম্ভাবনা ছাড়াই এতগুলো বিকল্প রয়েছে।
কিন্তু নিজস্ব গ্যাসের অনুসন্ধান ও আহরণ বাড়ানোর প্রশ্ন উঠলেই সরকারি মহলে একধরনের অনীহা লক্ষ করা যায়। এর কারণ, অনেকে বলেন আমদানি উৎসাহিত করা। আমদানি উৎসাহিত করার কারণ কী, তা-ও অনেকে বলেন এবং মানুষ তা বিশ্বাস করে।
দেশের গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার গল্প আমরা শুনছি অনেক আগে থেকে। প্রথমে হিসাব করা হয়েছিল, ২০১১ সালে দেশের গ্যাস ফুরিয়ে যাবে। তারপর বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে উৎপাদন কমতে থাকবে এবং ২০২০ সাল নাগাদ আর বাণিজ্যিক উত্তোলন সম্ভব হবে না। এখন কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ না করে বলা হচ্ছে ফুরিয়ে যাওয়ার কথা।
গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ার উপরিউক্ত প্রতিটি পূর্বাভাসের নিচে উল্লেখ থাকত, ‘যদি নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার না হয়।’ এটা তো চির সত্য। নতুন আবিষ্কার না হলে তো অচিরেই গ্যাস ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু অব্যাহতভাবে নতুন আবিষ্কারের উদ্যোগ থাকলে আমাদের দেশের গ্যাস কবে ফুরাবে, তা বলার সময় এখনো অনেক দূরে। কেননা, এখানে নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কারের অমিত সম্ভাবনা রয়েছে।