হোম > ছাপা সংস্করণ

খাঁচায় মাছ চাষ: সম্ভাবনা ও সমস্যা

শাইখ সিরাজ

স্রোতস্বিনী নদীতে জালের খাঁচা স্থাপন করে তার মধ্যে মাছ চাষ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় ৭০০ বছরের পুরোনো এক চর্চা। ইতিহাস বলে, চীনেই প্রথম ছোট খাঁচায় বেশি ঘনত্বে মাছ চাষ শুরু হয়েছিল ইয়াংঝি নদীতে ১৩০০ শতাব্দীতে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন নদীতে অনেক আগ থেকেই কমবেশি খাঁচায় মাছ চাষের নজির রয়েছে। এ দেশে খাঁচায় মাছ চাষের গোড়াপত্তন ঘটে গত শতকের সত্তরের দশকে কাপ্তাই লেকে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেছিলাম গাজীপুরের কালীগঞ্জের বালু নদে খাঁচায় মাছ চাষের উদ্যোগ নিয়ে প্রতিবেদন। যেসব নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ সফল, তার একটি হচ্ছে চাঁদপুরের ডাকাতিয়া।

এখন দেশের অনেক নদীতেই খাঁচায় মাছ চাষ দারুণ লাভজনক একটি কার্যক্রম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কয়েক বছর আগে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে খাঁচায় মাছ চাষের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেখানকার প্রান্তিক মৎস্যজীবীরা। সমবায় সমিতির মাধ্যমে ওই উদ্যোগ নেওয়া হলেও একসময় নদীদূষণসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় ওই উদ্যোগ আর এগোতে পারেনি।

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খাঁচায় মাছ চাষের উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। এর মাধ্যমে প্রান্তিক নারী-পুরুষ দ্রুতই আর্থসামাজিক উন্নতির সুযোগ করে নিতে পারছেন।

এযাবৎকালে বহু মানুষই খাঁচায় মাছ চাষ করেছেন। কেউ সফল হয়েছেন, কেউ ধৈর্যের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে সরে গেছেন। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে নরসিংদীর মেঘনা নদীতে। দিনে দিনে এখানে খাঁচার সংখ্যা বাড়ছে।

মাস দুয়েক আগে খাঁচায় মাছ চাষের বর্তমান পরিস্থিতি দেখতে গিয়েছিলাম নরসিংদীর করিমপুর ইউনিয়নে। সেখানে মেঘনা নদীর বিশাল এলাকাজুড়ে সারি সারি খাঁচায় মাছ চাষ হচ্ছে। ২০১০-১১ সালের দিকে ওই এলাকায় সুরুজ আলী, কামাল হাজি ও মোহর আলী তিনজনে মিলে এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেন।

সুরুজ আলীর সঙ্গে কথা হয় আমার। তিনি বলছিলেন, তিনজনে শুরু করলেও এখন প্রায় ১০০ জন এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করছেন। নদীতে খাঁচা আছে প্রায় ৬ হাজার। 

সুরুজ আলী বলছিলেন তাঁর নিজের গল্প। মাত্র কয়েকটি খাঁচা দিয়ে শুরু করলেও এখন তার ১০০টির মতো খাঁচায় মাছ চাষ হচ্ছে। এই ১০০ খাঁচায় মাছ চাষ করতে বছরে খরচ হয় ১ কোটি টাকার মতো। বছর শেষে লাভ থাকে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। প্রতিটি খাঁচার দৈর্ঘ্য ২০ ফুট আর প্রস্থে ১০ ফুট। কালীগঞ্জের বালু নদে যখন এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ হয়, তখন খাঁচার জন্য ফ্রেম তৈরি করেছিল বাঁশ দিয়ে। বাঁশের ফ্রেমে জালটাকে মশারির মতো উল্টো করে বেঁধে তাতে মাছ চাষ হতো। প্রযুক্তিগতভাবে এখনো তেমন পরিবর্তন আসেনি। বাঁশের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে প্লাস্টিকের পাইপ। অথচ থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামে দেখেছি তারা প্রযুক্তিগতভাবে আরও উন্নত।

নৌকায় করে খাঁচা থেকে খাঁচায় যেতে কথা হচ্ছিল অনেকের সঙ্গেই। কথা হলো আরেক মাছচাষি মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। দীর্ঘ প্রবাসজীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে মোহাম্মদ আলী খাঁচায় মাছ চাষ করে আগের যেকোনো অবস্থা থেকে ভালো আছেন। তিনি বললেন, সাত বছর আগে ২০টি খাঁচা দিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন। খাঁচা স্থাপনা থেকে শুরু করে সারা বছরে খরচ ছিল ৫ লাখ টাকা।

ভালোই লাভ হয় দেখে খাঁচার সংখ্যা বেড়েছে বছরে বছরে। এখন তার ৭০টি খাঁচায় মাছ চাষ হয়।

আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চিন্তায় বেসরকারি চাকরি ছেড়ে মেঘনার বুকে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষে নেমেছেন মঞ্জুর ইসলাম। ২০টি খাঁচা থেকে বছরে তিনি ৪ লাখ টাকার মতো লাভ করেন। তাঁর খাঁচা থেকে মাছ তুলে দেখালেন। দেখলাম তেলাপিয়া মাছগুলো উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যবান। নদীর মাছের মতোই। খাঁচায় চাষ করা মাছে সাধারণত গন্ধ থাকে না। আর প্রবহমান পানিতে থাকা খাদ্য মাছ খেতে পারে বলে খাবার খরচও কিছুটা কম হয়।

২০০ খাঁচায় মাছ চাষ করেন ইব্রাহিম। তিনি বললেন, ১ কেজি মাছ উৎপাদন করতে ২ কেজি খাবার খাওয়াতে হয়। ২ কেজি খাবারের দাম ১৫০ টাকা। আর ১ কেজি মাছের দাম ১৮০ টাকা।

কেজিপ্রতি মাছে থাকে ৩০ টাকা করে। এই ৩০ টাকায় আছে আরও আনুষঙ্গিক খরচ। সবকিছু বাদে কেজিতে ১০ থেকে ১২ টাকা লাভ রাখা যায়। কিন্তু মাথায় রাখতে হয় লোকসানের হিসাবটাও।

ইব্রাহিমের খাঁচা ছিল ৭০০। এক দিনে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার মাছ নষ্ট হয়ে যায়। সব হারিয়ে তাঁর পথে বসার মতো অবস্থা। জানতে চাইলাম, কী হয়েছিল?

ইব্রাহিম জানালেন, কারখানার রঙের পানিতে সব মাছ মরে গিয়েছিল। কথা বলতে বলতে একটা বড় নৌকার পাটাতনে গিয়ে বসলাম। সেখানে জড়ো হলেন ১০-১২ জন মাছচাষি। তাঁরা তাঁদের সমস্যার কথা তুলে ধরলেন। সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশদূষণের কবলে পড়েছে খাঁচায় মাছ চাষও। স্থানীয় কাপড়ের মিলের রঙের বর্জ্যে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ছেন তাঁরা। এমনিতে নদীতে পানি যখন বেশি থাকে, তখন খুব একটা সমস্যা না হলেও ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত যখন নদীতে পানি কম থাকে, তখন তাঁরা মাছ চাষ করতে পারেন না। রঙের পানিতে সব মাছ মরে যায়।

মাছচাষি মঞ্জুরুল বললেন, ‘আমরা খাঁচায় মাছ চাষ করি। কোটি টাকা বিনিয়োগ করছি, কিন্তু আমরা ব্যাংক থেকে কোনো রকম ঋণ নিতে পারি না। যেহেতু আমাদের পুকুর নেই, তাই ঋণ দিতে চায় না।’ ভেবে দেখলাম, কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। ব্যাংকগুলো আন্তরিক হলে এখানকার মাছচাষিরাও তো ঋণ পেতে পারেন। আরও ভালো হয় এদের যদি বিমার আওতায় আনা যেত।

নানাবিধ সমস্যার মধ্য দিয়েও এখানকার মাছচাষিরা নিজেদের ভালো থাকার পথ খুঁজে নিয়েছেন। লড়াই করছেন প্রকৃতির সঙ্গে, লড়াই করছেন মানুষের সঙ্গে। নদী থেকে ওঠানো খাঁচার মাছের মতোই তরতাজা হয়ে উঠেছে এখানে যুক্ত অনেক তরুণের জীবন। লেখাপড়া শিখে কাজের সন্ধানে নানা জায়গায় ঘুরে শেষে এই জালের জীবনে সফল হয়েছেন অনেকে। দিনে দিনে এই এলাকার মানুষের খাঁচা পদ্ধতিতে মাছ চাষের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। মাছচাষিদের মতে, গোটা জেলায় এখন প্রায় ৬ হাজার খাঁচায় মাছ চাষ হচ্ছে, যার সঙ্গে শত শত উদ্যোক্তা সফলতার সঙ্গেই মাছের চাষকে এগিয়ে নিচ্ছেন।

এমন অগণিত সফল উদ্যোক্তা, মৎস্যজীবী ও চাষির হাত ধরেই আজ মাছ উৎপাদনে পৃথিবীতে তৃতীয় স্থানে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। বাঙালির চিরায়ত পরিচয় ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ দিনে দিনে বিকশিত হচ্ছে বিশ্ববাসীর সামনে। মাছ উৎপাদনের ছোট-বড় সব ক্ষেত্র যুক্ত হয়েই তো সৃষ্টি হয়েছে গোটা দেশের সাফল্য। এমন সাফল্যের একেকটি দৃষ্টান্ত দেখে শুরু হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোগ। খাদ্য কিংবা পুষ্টি জোগানের এই উদ্যোগগুলোকেই আজকের দিনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কেননা, মহামারি করোনার পর গোটা পৃথিবীর পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষেরও আয় কমেছে, বেড়েছে দারিদ্র্য। এ অবস্থায় আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা বা পুষ্টিনিরাপত্তা। আগামীর সংকট দূরীকরণের স্বার্থেই নরসিংদীর মেঘনা নদীতে গড়ে ওঠা জালের খাঁচায় মাছ চাষের মতো দৃষ্টান্তগুলো দেশের সব নদ-নদীতে সম্প্রসারণ করা দরকার। পাশাপাশি নদীকে বাঁচাতে হবে দূষণের হাত থেকে। আগামী সমৃদ্ধির জন্যই কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে নদী ও পানিদূষণ। 

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ