২৫ মার্চ রাতটি শাহীন সামাদের জীবনে এসেছিল আর সব ঢাকাবাসীর মতো। চারদিকে করুণ আর্তনাদ, চিৎকার, গুলির শব্দ—যেন পৃথিবীর শেষ ঘণ্টা বাজছে। ছায়ানটের শেখ লুৎফর রহমানের কাছে শাহীন শিখেছেন, ‘বিপ্লবের রক্তে রাঙা উড়ে আকাশে’, ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’, ‘এই শিকল-পরা ছল মোদের’ গানগুলো। ঢাকার ভয়াবহ জীবন বিষিয়ে উঠল শাহীন সামাদের। ঠিক করলেন সীমান্ত পাড়ি দেবেন। ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল একটা কালো বোরকা পরে বেরিয়ে গেলেন নিরুদ্দেশের পথে। কয়েকজন একত্র হয়ে বাসে করে চলে গেলেন কুমিল্লায়। চারদিকে চেকপোস্ট। কারও কাছে চিঠি বা চিরকুট পেলে রক্ষা নেই।
চান্দিনা থেকে রিকশায় করে সোনামুড়া হয়ে আগরতলায় যাওয়া হবে। এ সময় যমের মতো একটা আর্মির গাড়ি রিকশার সামনে এসে দাঁড়াল, ‘কৌন হ্যায়’ বলে চিৎকার করলো। দলের একজন বলল, ‘শ্বশুরায় যা রাহা হ্যায়’। দশ সেকেন্ড সবার দিকে তাকিয়ে থেকে আর্মির গাড়ি চলে গেল।
আগরতলায় পরিচিত অনেককেই পাওয়া গেল। সেখান থেকে তাঁরা চলে এলেন কলকাতায়। ৪৪ নং লেনিন সরণিতে রিহার্সাল হতো। ৩৫ জন মানুষ জবুথবু হয়ে থাকেন একটি বাড়িতে। করেন রিহার্সাল। ওয়াহিদুল হক কলকাতায় এলে গড়ে ওঠে মুক্তিসংগ্রামী শিল্পীদের দলটি। সভাপতি সন্জীদা খাতুন, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বেনু। একটি ট্রাকে করে তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গিয়ে গান শোনাতেন। এ-ও একরকম যুদ্ধ। মাস শেষে প্রত্যেকে পেতেন এক শ টাকা করে। সারা দিন হয়তো একটি শিঙাড়া খেয়ে দিন যাপন করতে হতো। এর মধ্যে গান আর গান।
একদিন এক দাওয়াতে গিয়ে দেখেন সবজি ছাড়াও মাছ-মাংসের পাহাড়। কিন্তু বহুদিনের অনভ্যাসে শাহীন গেলেন সবজির দিকে। সবাই হা হা করে উঠলেন। বললেন, ‘কী করছিস? পেটপুরে মাছ-মাংস খেয়ে নে।’
সূত্র: শাহীন সামাদ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৫৮-১৬৫