নিয়মের কোনো তোয়াক্কা না করেই পাবনার পাপা রোমা নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে অভিনব কায়দায় ৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংক। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের সভাপতিত্বে ৭৮তম সভায় এই ঋণের অনুমোদন দেওয়া হয়। যে জমি বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়ার কথা, উল্টো সেই জমি কেনার জন্য আগে ঋণ দিয়ে পরে জমি বন্ধক রাখা হয়। যাকে বাংলাদেশ ব্যাংক সুস্পষ্ট জালিয়াতি হিসেবে দেখছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্যাংকটির পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর শাখা থেকে পাপা রোমা নামক কনসালট্যান্সি ফার্মের মালিক মো সাইফুর রহমানকে ঋণ প্রদান করা হয়। ঋণের জামানত হিসেবে সাইফুর রহমান ১৭৩ দশমিক ৫০ শতাংশ জমির কাগজপত্র জমা দেন। তবে জামানত হিসেবে গৃহীত জমির প্রকৃত মালিক ছিলেন না সাইফুর রহমান। কিন্তু ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ জেনেশুনেই এই ঋণ অনুমোদন দেয়, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের নিয়মের সরাসরি লঙ্ঘন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগের প্রতিবেদনে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, ব্যাংকের ঋণ নেওয়ার বিপরীতে জামানতের জন্য দেওয়া জমির রেজিস্ট্রেশন করার জন্য এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে পরামর্শ দেন সাইফুর রহমান। অর্থাৎ সাইফুর রহমান নিজের মালিকানা দাবি করে জমি কেনার আগেই তাঁর কাগজপত্র ব্যাংকের জামানত হিসেবে জমা দেন। তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে জমির মালিক শেখ আরশাদ গফুরকে চেকের মাধ্যমে প্রথম দফায় ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। ওই দিন টাকা পরিশোধের পরেই মো সাইফুর রহমানের নামে ১ দশমিক ০৮৩৭ একর জমি রেজিস্ট্রেশন করা হয়। আর একই সালের ৪ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় জমির মালিক হিসেবে রেজাউল করিম ও শেখ আরশাদ গফুরের নামে চেকের মাধ্যমে ২ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। একইভাবে দ্বিতীয় দফায় টাকা পরিশোধের তিন দিন পরে ৭ এপ্রিল ০.১০৬৩ একর জমি পাপা রোমার মালিক সাইফুর রহমানের নামে রেজিস্ট্রেশন করা হয়। এভাবে মূলধনি তহবিলের জন্য দেওয়া ঋণের টাকা জমি কেনায় ব্যবহৃত হয় এবং ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পর্ষদ পুরোপুরি অবগত ছিল।
ঋণ অনুমোদনের সময় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তমাল পারভেজসহ সংশ্লিষ্ট পরিচালক, তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঋণের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা জেনেশুনে ঋণ দেন, যা ২০১৮ সালের ব্যাংক প্রবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত অন্যরা হলেন মো. মাইনুল হোসেন (এসইও ও ক্রেডিট ইনচার্জ), মো ইমতিয়াজ হোসেন (এসইও ও ম্যানেজার অপারেশন), মো. রাশেদুল আলম (এফএভিপি ও শাখাপ্রধান), তনুশ্রী মিত্র (ইভিপি ও হেড অব সিআরএম), কাজী মো. তালহা (তৎকালীন ডিএমডি) ও তৎকালীন এমডি মো. মুখতার হোসেন।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ঋণের জন্য দুই দফায় বন্ধকি জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭০ দশমিক ৮৫ শতাংশ আর ঋণ প্রস্তাবনায় ছিল ১৭৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া ঋণের বিধি অনুযায়ী তৃতীয় পক্ষ থেকে মূল্যায়ন করে জমির মূল্য নির্ধারণ করার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। বরং জমির মূল্য উল্লেখের ক্ষেত্রে ব্যাংকটির সিআরএম ডিভিশন কর্তৃক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে মেমো উপস্থাপন করা হয়েছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট জালিয়াতি বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনুমোদনে বন্ধকি ও অন্যান্য কাগজপত্র দিয়ে বন্ধকের আগেই ৫ কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ নেন পাপা রোমা প্রতিষ্ঠানের মালিক সাইফুর রহমান।
অভিনব ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে এনআরবিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম আউলিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এটি পুরোনো ঋণ। আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে তা বিতরণ করা হয়েছে। ঋণের অগ্রগতি জানতে আরও খোঁজখবর নিতে হবে।’
এ বিষয়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পারভেজ তমালকে একাধিকবার কল করে এবং খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।