দেশে সম্প্রতি ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। রাজধানীতে একের পর এক ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর এবং এর মধ্যে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ বেড়েছে। ডেঙ্গুর প্রধান কারণ মশা। এই মশা অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটা প্রাণী, কিন্তু মানুষের এক নম্বর শত্রু হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে।
আসলে জীবনে কোনো কিছুই ক্ষুদ্র নয়, তুচ্ছ নয়। মশা এমনিতে ক্ষুদ্র হলেও এর প্রভাব মোটেও ছোট নয়। মশার কামড় আমাদের জীবনকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হওয়ার কারণে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। সেই দিক থেকে এটা পৃথিবীর বিভিন্ন যুদ্ধবাজ দেশ, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের চেয়ে কম ভয়াবহ নয়! প্রতিবছর এ ক্ষুদ্র জীবটি লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে। ম্যালেরিয়া ছাড়াও ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়া, ওয়েস্ট নাইল, ইয়োলো ফিভার ইত্যাদি রোগ মশা ছড়ায়। কাজেই মশাকে ক্ষুদ্র করে দেখার সুযোগ নেই। বিশাল ক্ষমতাশালী নমরুদের নাকের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশ করেছিল একটি ক্ষুদ্র খোঁড়া মশা!
যে মশা প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে, সেই মশাকে নিয়ে তুলনামূলকভাবে আলোচনা কিন্তু খুব কম হয়। মশা নিয়ে কাব্য, সাহিত্য, নাটক, সিনেমা তেমন নেই বললেই চলে। হলিউডে উদ্ভট সব কল্পিত প্রাণীকে নিয়ে সিনেমা হয়। যে ডাইনোসর বহু শতাব্দী আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, সেই ডাইনোসরকে নিয়ে ‘জুরাসিক পার্ক’ নির্মিত হয়েছে একাধিক পর্ব। এই সিনেমা অস্কারও জিতেছে। গডজিলা নামে এক কল্পিত প্রাণীকে নিয়ে নির্মিত সিনেমা সারা দুনিয়ায় কোটি কোটি টাকা ব্যবসা করেছে। সিনেমা হয়েছে ভ্যাম্পায়ার ও ড্রাকুলা নিয়েও। হলিউড-বলিউডে সিংহ, হাতি, বাঘ, কুকুর, ঘোড়া, সাপ, বিড়াল, এমনকি খরগোশ ও ইঁদুরকে নিয়েও অনেক সিনেমা তৈরি হয়েছে।
কিন্তু মশা নিয়ে তেমন কোনো সিনেমা নির্মিত হয়নি। বাংলা সাহিত্যে আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে রচিত ‘রেতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে কলকাতায় আছি’র বাইরে তেমন কোনো স্মরণীয় পদ বা কবিতা গোচরীভূত হয়নি। আসলে আমরা বড় জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছোটখাটো জিনিসের প্রতি নজর দিই না। এতে করে ছোটটার ক্ষতি অনেক বড় হয়ে দেখা দেয়। এখন যেমন আমাদের দেশে অনেক বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু।
কথা আছে, বিপদ একা আসে না। আমাদের জীবনে তো আরও নয়। আমাদের ক্ষেত্রে আপদ-বিপদ-মুসিবতগুলো হাত-ধরাধরি করে আসে। একটা এসে ঠ্যাং ভেঙে দেয়, আরেকটা হাত। তো আরেকটা এসে কোমর ভেঙে দিয়ে যায়। একটু যে কাঁদবেন, তারও উপায় নেই। আরেক বিপদ এসে হয়তো আমাদের থোঁতা মুখটাই ভোঁতা করে দেয়!
আমাদেরও এখন একের পর এক বিপদ। এমনিতেই আমরা করোনার প্রভাব থেকে এখনো পুরোপুরি মুক্ত হতে পারিনি। রয়েছে ইউক্রেন-রশিয়া যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট আর্থিক সংকট, জ্বালানি-সংকট। মিয়ানমারের শাসকদের চণ্ড আচরণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশের সমস্যা। এত সব সমস্যায় আমরা যখন হিমশিম খাচ্ছি, তখন নতুন করে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। যার মূল কারণ মশা। মশা মারার ক্ষেত্রে আমাদের সম্মিলিত উদাসীনতা ও ব্যর্থতার কারণেই এখন ডেঙ্গু নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে।
মশাকে যতই তুচ্ছ ও অবহেলা করা হোক না কেন, জীবাণু সংক্রমণকারী এই মশাই পৃথিবীতে সবচেয়ে জীবনঘাতী পতঙ্গ। পৃথিবীতে ৩ হাজার ৫০০ প্রজাতির মশা উড়ে বেড়াচ্ছে। এসব মশার শতকরা মাত্র ৬ ভাগ হলো স্ত্রী-মশা এবং এরাই মানুষকে কামড়ায়, মানুষের রক্ত খায়। এই ৬ ভাগের অর্ধেক, অর্থাৎ মাত্র শতকরা ৩ ভাগ মশা মানুষের শরীরে রোগজীবাণুর সংক্রমণ ঘটায়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই ৩ ভাগ মশা মেরে সাফ করতে পারলে লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে!
বিজ্ঞানীরা তো বলেই খালাস, কিন্তু মশাটা মারবে কে? মশা মারতে কামান দাগা ছাড়া আমাদের ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়ররা কিন্তু আর সবই করেছেন। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা নিধনে অনেক উদ্যোগ-আয়োজন, কর্মতৎপরতা, ঢাকঢোল পেটানো—অনেক কিছুই করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
উল্লেখ্য, একটা সময় পর্যন্ত ঢাকা শহরের ময়লা-আবর্জনা সাফ করা, শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখা, মশা মারা, ফুটপাত থেকে হকারদের উচ্ছেদ করা ইত্যাদি কাজের জন্য ছিল সিটি করপোরেশনের একটা ‘মাথা’। পরবর্তী সময়ে এই কাজগুলোকে সুষ্ঠু, সহজ ও পরিপূর্ণভাবে করার জন্য একটা ‘মাথা’কে অপারেশন করে কেটে দুটি ‘মাথা’, অর্থাৎ দুটি সিটি করপোরেশনের জন্ম দেওয়া হয়েছে। একটি মাথা উত্তর, আরেকটি মাথা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। জন্মের পর থেকেই দুই মেয়রকে দুই মাথা নিয়ে বেশ সক্রিয় হতে দেখা গেছে, বিভিন্ন বিষয়ে মাথা ঘামাতে দেখা গেছে। শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে শপথের সঙ্গে নিজেরা হাতে ঝাড়ু নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। এডিস মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করেছেন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র এমন ঘোষণাও দিয়েছিলেন, কোনো বাসাবাড়িতে যদি এডিস মশার ডিম-লার্ভা পাওয়া যায়, তাহলে সেই বাসাবাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যদিও পরবর্তী সময়ে এটা জানার সৌভাগ্য হয়নি যে এডিস মশার ডিম ও প্রজননক্ষেত্র শনাক্ত হওয়ার পর দায়ী করে বাসাবাড়ির কজন মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
মশানিধনের ব্যাপারে আওয়াজ যতটা শোনা যায়, ধারাবাহিক কার্যকর উদ্যোগ ততটা দেখা যায় না। এর ভিন্ন কারণ থাকতে পারে। আমাদের মেয়ররা সম্ভবত স্বামী বিবেকানন্দের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। ক্ষুদ্র হলেও মশারাও তো জীব!
মেয়র, স্বাস্থ্য বিভাগ, নাগরিক—মশা মারা শেষ পর্যন্ত কারও পক্ষেই হয়তো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে মশা বিষয়ে আমাদের প্রচলিত মনোভাবটা বদলে ফেলতে হবে। মশাকে ক্ষতিকর হিসেবে না দেখে এর উপকারের দিকগুলো সামনে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে মশা মারার কঠিন ও ‘হিংস্র’ পদক্ষেপ থেকে যেকোনো হৃদয়বান মানুষই দূরে সরে যাবে। একবার নিজেকে মশা ভাবুন, ফগার মেশিনের অশ্লীল আওয়াজ আর ঝাঁজালো ধোঁয়ার কথা কল্পনা করুন। কী নির্মমভাবেই না মশাকে হত্যা করা হয়! আরেকভাবে ভাবুন, মশা না থাকলে আমরা হয়তো অলস সময় কাটাতাম, নিজের প্রতি যত্ন নিতাম না। মশার উৎপাত মানেই মশারি টাঙানো কিংবা কয়েল জ্বালানো। আর এই দুটি কাজই চরম অলসতার মুহূর্তে আমাদের কর্মঠ ও স্বাস্থ্যবান হতে সহায়তা করে। আর মশা মারতে হলে বিদ্যুৎবেগে যে থাপ্পড় দিতে হয়, এতে আমাদের হাতেরও ব্যায়াম হয়।
টিভি দেখতে দেখতে অনেক সময় ঘুম এসে যায়। এতে মজার কোনো নাটক, টক শো বা সিনেমা মিস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু হঠাৎ মশার কামড় আমাদের এই অসময়ের ঘুম দূর করে। কিছু মশা আছে, যারা উদ্ভিদের কাণ্ডের রস খেয়ে বেঁচে থাকে। এসব মশা উদ্ভিদের পরাগ-সংযোগে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাকড়সা, টিকটিকি, গিরগিটি, ব্যাঙ, বাদুড়সহ বেশ কিছু প্রাণীর প্রধান খাদ্য এই মশা। তাই জীবজগতের খাদ্যশৃঙ্খলের ওপর মশার প্রভাব রয়েছে।
পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে, যেগুলোর ব্যবহার পদ্ধতি আমরা এখনো জানি না। তার মানে এই নয় যে সেটার কোনো উপকারিতা নেই। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন যুগে আগুনের ব্যবহার কীভাবে করতে হয়, তা মানুষ জানত না। তখন তাদের কাছে আগুন খুবই ভয়ংকর জিনিস ছিল। কিন্তু তারা যখন আগুনের ব্যবহার শিখল, তখন সমাজ-সভ্যতা দ্রুত পাল্টে গেল। মশার ইতিবাচক ব্যবহার হয়তো আমরা এখনো জানি না। তার মানে এটা নয় যে, এর কোনো উপকারিতা নেই। হয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একদিন সেই রহস্য উদ্ভাবন করবে। তখন আমরা ঘরে ঘরে মশার চাষ করব!
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট