১৮৭৬ সাল। সিজার লম্ব্রোসো নামের এক ভদ্রলোক তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করলেন। মূল কথা, অপরাধপ্রবণতা মানুষ পূর্বপুরুষদের সূত্রেই পেয়ে থাকে এবং মানুষের অপরাধপ্রবণতা তার শারীরিক গঠনেও প্রতিফলিত হয়। বলাই বাহুল্য, অপরাধবিজ্ঞানের জনক সিজার লম্ব্রোসোর এই তত্ত্ব ব্যাপকভাবে সমালোচিত এবং অপরাধবিজ্ঞানে এই তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা অকাট্য নয়। তবু অপরাধবিজ্ঞান পড়তে গেলে লম্ব্রোসোকে পড়তেই হয়, পড়ানোই হয়।
আমাদের দেশে গবেষণা করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হওয়ার গল্প অনেক জমা আছে। অনেক ঘটনা জানি, যেখানে গবেষণার বিষয়বস্তুই বদলে ফেলতে হয়েছে শুধু উপাত্ত জোগাড় করতে না পারার কারণে। অথচ প্রায় দেড় শ বছর আগে লম্ব্রোসো তথ্য জোগাড় করতে মোটামুটি পৌনে তিন শ মৃত অপরাধীর শরীর খুঁটে খুঁটে দেখেছেন, ঘুরে ঘুরে জীবিত অপরাধীদের মাথা-চোখ-নাক ধরে দেখেছেন, পরীক্ষা করেছেন। লম্ব্রোসোর গবেষণার আরও অনেক বছর পর গোরিং নামের ব্রিটিশ এক অপরাধবিজ্ঞানীও ঘুরে ঘুরে অপরাধীদের শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, যদিও লম্ব্রোসোর তত্ত্বের সঙ্গে তেমন মিল তিনি পাননি।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা হয় না—এই অভিযোগ পুরোনো। তবে কেন হয় না, সেটা নিয়ে কোনো এক বাক্যের উত্তর নেই। টাকাপয়সার অভাবে গবেষণা হয় না—এটা সত্য ধরে নিলেও তা অনেকটা অজুহাতের মতোই ঠেকে। তবে গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দ কম বা নেই এবং সে কারণে গবেষণায় আগ্রহ কম, সেটা বরং গ্রহণীয় যুক্তি।
আমাদের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আর ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার সুনাম প্রণিধানযোগ্য। অন্যদিকে সামাজিক বিজ্ঞানে গবেষণা বেশি হয় না, সেটাও বলা যাবে না। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বিষয়েই, সেটা স্নাতক হোক আর স্নাতকোত্তর, গবেষণাপত্র জমা একটা দিতেই হয়। প্রায় প্রতিটি বিভাগ বা অনুষদ তাদের মতো করে জার্নালও প্রকাশ করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন গবেষণার ওপর আলাদা করে গুরুত্বও দিচ্ছে। সুতরাং গবেষণা হয় না—এমন কথা খুব সত্য নয়। বলা যেতে পারে, আলোড়ন সৃষ্টিকারী গবেষণা হচ্ছে না।
আলোড়ন সৃষ্টিকারী গবেষণা কম হওয়ার কারণ কী? শুধুই অর্থের অভাব? টিআইবি, বিডিএস, সিপিডি, সুজনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তনির্ভর যেসব গবেষণাভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, সেগুলো প্রায়ই আলোড়ন সৃষ্টিতে সক্ষম হয়। যদিও এসব রিপোর্ট আলোচিত হওয়ার মূল কারণ সম্ভবত অন্য—এসব গবেষণার বেশির ভাগই হয় সরকারের দোষত্রুটি-সংক্রান্ত। গণমাধ্যমের তৈরি তথ্যনির্ভর রিপোর্টও বেশ আলোড়ন তৈরি করতে পারে। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের নিষ্পত্তি করা মামলা নিয়ে প্রথম আলোর কয়েকজন সংবাদকর্মীর তৈরি অনুসন্ধানধর্মী একটি রিপোর্ট ‘সাজা মাত্র ৩ শতাংশ’ সে সময় বেশ আলোচিত-প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু এ রকম তথ্যনির্ভর এবং গবেষণাধর্মী রিপোর্ট সংখ্যায় খুব কম, প্রায় নেই বললেই চলে।
কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান হোক কিংবা গণমাধ্যম, যাঁরাই গবেষণাধর্মী রিপোর্ট তৈরি করেছেন বা করছেন, তাঁরা এটা করছেন অনেক ক্ষেত্রেই পেশাগত দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে। কিন্তু গবেষণা যেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে হওয়ার কথা, সেটা কেন আমাদের নড়াতে-চড়াতে পারছে না? অনুমান করি, সেসব গবেষণা এমন বিষয় নিয়ে হচ্ছে না, যেগুলো সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করবে বা প্রচলিত কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বা প্রভাবিত করবে।
আলোড়ন সৃষ্টিকারী গবেষণা সাধারণত বৃহৎ পরিসরে হয়, কিংবা এর প্রভাব হয় বিস্তৃত। প্রচুর সময় নিয়ে করা এসব কাজে গবেষকেরা শুধু গবেষণাতেই ডুবে থাকেন। বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো সমাজের নানাবিধ ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে গবেষণা করেছেন, যার প্রায় সবই আলোড়িত করেছে সমাজকে, অনেক ক্ষেত্রে পুরো পৃথিবীকেই। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তুর মধ্যে অন্যতম ছিল জ্ঞান আর ক্ষমতার সম্পর্ক, কারাগার, পাগলাগারদ, শাস্তিব্যবস্থা ইত্যাদি এবং এগুলো নিয়ে তাঁর করা গবেষণা অনেক বিখ্যাত বিদ্যাপীঠের অবশ্যপাঠ্য। তিনি এসব গবেষণা করেছেন বছরের পর বছর ধরে। বের করে এনেছেন এমন কিছু, যা নাড়িয়ে দিয়েছে বহুকাল ধরে চলে আসা সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের ভিত। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে বিশ্বখ্যাত বিদ্যাপীঠ ফ্রান্সের কলেজ ডে ফ্রান্স ‘চেয়ার প্রফেসর’ করেছিল ফুকোকে, যেখানে তাঁর কাজ ছিল বছরে একটা পাবলিক লেকচার দেওয়া। লেকচারের বিষয়বস্তু—তাঁর নতুন কোনো গবেষণা বা আগের গবেষণার কোনো অগ্রগতি। ব্যস এটুকুই। অন্য কিছু না। এমনকি ছাত্র পড়ানোটাও না।
লম্ব্রোসো, গোরিং, ফুকো যেসব বিষয় নিয়ে এবং যেভাবে গবেষণা করেছেন, যেসব জায়গা থেকে তাঁরা তথ্য জোগাড় করেছেন আর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের ‘কাম-কাজ’ ছাড়াই যেভাবে বেতন দিয়ে রেখেছিল, সেসব কি আমাদের এখানে আদৌ সম্ভব?
আমাদের এখানে কোনো তথ্য জোগাড় করতে গেলে নানা হ্যাপায় পড়তে হয়। বাপ-দাদা চৌদ্দগোষ্ঠীর নাম লিখে আবেদন করতে হয়। একেক তথ্য জোগাড়ের জন্য একেক সময় যেতে হয়। অসহযোগিতামূলক আচরণ সহ্য করতে হয়। তার ওপর কারও কোনো অনুভূতিতে আঘাত লাগবে কি না, সেটাও ভাবতে হয়। এত কিছু চিন্তা করে গবেষণা শুরুর আগেই রাজনৈতিক-সামাজিক-ধর্মীয়সহ নানাবিধ অন্তরায়ের কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত ‘যদি উপাত্তই জোগাড় করতে না পারি’ এই আতঙ্কে কোনো গবেষক যদি গবেষণার আগ্রহটাই হারিয়ে ফেলেন, তাতে দোষটা আসলে কার হয়?
অবাধ তথ্য-উপাত্ত আর তত্ত্বের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা গেলে ফুকো, ফ্রয়েড, লম্ব্রোসো আমাদের এখানেও কম হবে না। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কুদরাত-এ-খুদা, জগদীশচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী আর এ সময়ের বুয়েটের জারিন তাসনিম শরিফের দিকে তাকালেই তা আমরা নিশ্চিন্তে বলতে পারি। এ বছর ‘দ্য আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন জারিন তাসনিম শরিফ। জুনিয়র নোবেল পুরস্কার হিসেবে পরিচিত এই পুরস্কার তাঁর হাতে এসেছে মূলত স্নাতক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেওয়া তাঁর গবেষণাপত্রের সূত্র ধরেই।
অনেকেই ভুলে যান, তবে আমাদের সংবিধান কিন্তু চিন্তা আর বিবেকের অবারিত স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে, যা কিনা এক অর্থে তত্ত্বেরই স্বাধীনতা। সুতরাং গবেষকদের জন্য তথ্য-উপাত্ত উন্মুক্ত করা প্রয়োজন, তাঁদের তথ্য-উপাত্ত জোগাড়ে সহযোগিতা বৃদ্ধি প্রয়োজন, আর প্রয়োজন চিন্তার তথা তত্ত্বের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। তা না হলে অন্তত আর্থসামাজিক কিংবা রাজনৈতিক বিষয়ে মানসম্মত, সময়োপযোগী আর কার্যকর গবেষণা খুব একটা আশা করা যাবে না। সেটা উচিতও হবে না। ইট-রড-সিমেন্ট-বালু-পাথর ছাড়া যেমন আকাশচুম্বী দালান তৈরি সম্ভব নয়, তেমনি তথ্য-উপাত্ত আর তত্ত্বের স্বাধীনতা ছাড়া সাড়াজাগানো গবেষণাও সম্ভব নয়।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট