১৯৭১ সালের সাতই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ শেষ করেছিলেন এই বলে যে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বাঙালি জাতির সংগ্রামকে তিনি একাধারে ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ও ‘মুক্তির সংগ্রাম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এ হয়তো নিছকই স্বাভাবিক শব্দচয়ন। কিন্তু আমার মনে হয়, তা কিন্তু নয়। অত্যন্ত সচেতনভাবে বঙ্গবন্ধু শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন তাদের অন্তর্নিহিত অর্থ মনে রেখে। ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তির’ ব্যঞ্জনা ভিন্ন।
একটি জাতির রাজনৈতিক স্বাধীনতা এলেই তার অর্থনৈতিক মুক্তি আসে না। স্বাধীনতা অর্জন করার পরেও একটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বঞ্চনা থাকতে পারে, অসাম্য থাকতে পারে, অন্যায় থাকতে পারে। এগুলো দূর করতে পারলেই তখন কেবল অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব। সুতরাং বঙ্গবন্ধু জানতেন যে বাঙালি জাতির সংগ্রাম শুধু স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে শেষ হবে না, তার অর্থনৈতিক মুক্তিও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থনৈতিক মুক্তির আবশ্যকীয় শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়।
এই চালচিত্র মাথায় রেখে চারটি বিষয়কে জাতীয় নীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তার বোধ একটি জাতির রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য দরকার।
গণতন্ত্রকেও বঙ্গবন্ধু শুধু রাজনৈতিক গণতন্ত্র হিসেবে দেখেননি। তিনি এটাকে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র হিসেবেও দেখেছেন। সুতরাং সম্পদে সবার সমান অধিকার, অর্থনৈতিক সুযোগে সাম্য নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে সব মানুষের সমান কণ্ঠস্বরের কথা তিনি বলেছেন। এ ব্যাপারে তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সম্পদ ও সুযোগে সম অধিকার এবং সেই সঙ্গে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি। নর-নারীর মধ্যে সাম্যের ব্যাপারটিও তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে।
অর্থনৈতিক গণতন্ত্র সুনিশ্চিত করার জন্য কতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। প্রথমত, ব্যাংক-বিমাশিল্প জাতীয়করণের মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক অবকাঠামোগুলো যেন বাংলাদেশের জনগণের সম্পদ হয়েই থাকে, তার সেবাগুলো যেন সাধারণ মানুষের কাছে লভ্য হয়। পাট ও বস্ত্রশিল্প জাতীয়করণের মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে দেশের বৃহৎ শিল্পের মালিকানা যেন বড় পুঁজিপতিদের হাতে না চলে যায়। বৃহৎ পুঁজির শোষণ তিনি পাকিস্তান আমলে দেখেছেন।
দ্বিতীয়ত, প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতার পথে বাংলাদেশকে চালনা করতে চেয়েছেন। তাই স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ অর্থনীতিকে তিনি লাগামছাড়া বাজার অর্থনীতির হাতে ছেড়ে দেননি এবং বিশ্ব অর্থনীতির কাছে উন্মুক্ত করে দেননি। তিনি জানতেন যে নবীন কিন্তু সম্ভাবনাময় এই অর্থনীতিকে বৃহৎ পুঁজির হাতে ছেড়ে দিলে তারা এটা কুক্ষিগত করে নেবে এবং সাধারণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী এতে শোষিত হবে। তেমনিভাবে তিনি বিশ্বাস করতেন যে বাংলাদেশে অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করে দিলে এই নবীন ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠবে না এবং শিগগিরই এই অর্থনীতি অন্য অর্থনীতির বাজারে পরিণত হবে।
তৃতীয়ত, বঙ্গবন্ধু জানতেন যে গ্রামীণ অর্থনীতি, বিশেষত কৃষি খাত হচ্ছে বাংলাদেশ অর্থনীতির প্রাণের চালিকা শক্তি। বাংলাদেশের জনশক্তির সর্বোচ্চ অংশই এই খাতের কর্মে নিয়োজিত। বাংলাদেশের দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরও আয় ও কর্মের মূল বলয় হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি ও কৃষি খাত। নগর অর্থনীতিরও প্রধান চালিকা শক্তি এই খাত।
গ্রামীণ অর্থনীতির দরিদ্র এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা এবং তাঁদের অর্থনৈতিক জীবনে গতিময়তা সুনিশ্চিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের কৃষি খাতে সমবায় প্রথার প্রচলনের কথা বলেছেন। তিনি চেয়েছিলেন যে কৃষিকাজে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষির অধিকার এবং প্রাপ্য যেন সুনিশ্চিত হয়। সে লক্ষ্যেই জমি-মালিকানার ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, যাতে বাংলাদেশের কৃষি জোতদারদের হাতে চলে না যায়। ভূমির পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে দরিদ্র চাষিদের ভূমির মালিক করার প্রয়াস ছিল তাঁর।
উৎপাদন বৃদ্ধি, সুষম বণ্টন, কর্মসংস্থান ও গ্রামের সামগ্রিক উন্নয়ন—এই চারটি মূল লক্ষ্য সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু তাঁর বিশেষ গ্রাম প্রকল্প প্রণয়ন করেছিলেন। উন্নতমানের বৈমানিক ব্যবস্থায় উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে কৃষি ও সংশ্লিষ্ট সব খাতে উৎপাদন বর্ধিত করতে হবে। সুষম বণ্টনব্যবস্থার মূল লক্ষ্য একদিকে যেমন উৎপাদন উপকরণগুলো সমবায় সমিতির আওতায় এনে সম্পদ ও উপকরণে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করা, তেমনি অন্যদিকে ফলাফলের বণ্টনেও সমানুপাতিকতা বহাল রাখা। গ্রামাঞ্চলে চাষাবাদের মাত্রা বাড়িয়ে, অকৃষি খাতে নানান কার্যক্রম গ্রহণ করে এবং ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সবার জন্য উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হবে।
বঙ্গবন্ধুর মতে, বিশেষ গ্রাম সমবায় প্রকল্পের সামগ্রিক লক্ষ্য হবে বাস্তবানুগ পরিকল্পনার দ্বারা গ্রামের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে গ্রাম ও গ্রামবাসীকে স্বাবলম্বী ও স্বয়ম্ভর করে তোলা, গ্রাম উন্নয়নমুখী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং গ্রামের ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তুলে গ্রামোন্নয়নে পূর্বশর্ত সৃষ্টি করা এবং গ্রামীণ সমাজের যাবতীয় দিককে এই প্রকল্পের আওতায় এনে গ্রামের সার্বিক ও সর্বাত্মক উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন যে বাংলাদেশে সব মানুষ ধর্ম ও জাতনির্বিশেষে সম অধিকারে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে। সেটাই তো বাংলাদেশের ঐতিহ্য। ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি তাই একটি সমতার উপকরণ হিসেবে দেখেছিলেন। একটি বহুধা ধর্মসম্পন্ন সমাজে সবার অধিকারকে নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ হতেই হবে। ধর্ম সেখানের ব্যক্তিগত ব্যাপার, রাষ্ট্রীয় সত্তার ব্যাপার নয়। বঙ্গবন্ধু বারবার বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।’
রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ও সমাজজীবনে তিনি ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদকে এমন জায়গায় রেখেছেন, যেখানে বাঙালি জাতির আত্মসত্তা-অস্তিত্বে কোনো দ্বন্দ্ব না থাকে, আর ধর্ম বিষয়ে কোনো সংশয় না থাকে। পরবর্তী সময়ের সব দ্বন্দ্ব ও সংশয়ের স্রষ্টা আমরাই—বহু মীমাংসিত বিষয়কে আবার ঘোলাটে করে দিয়ে।
শোষণের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপসহীন। সারা জীবন তিনি শোষণের বিরুদ্ধে বলেছেন, বঞ্চিত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন শোষকদের বিরুদ্ধে। শোষণকে তিনি দেখেছেন বঞ্চনার একটি শক্তিশালী খুঁটি হিসেবে, সাম্যের পরিপন্থী হিসেবে এবং মানবাধিকারের সঙ্গে সংগতিহীন হিসেবে। সেই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই তিনি বলেছেন, ‘বিশ্ব আজ দুটো শিবিরে বিভক্ত– শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’
তাই বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রকে একটি যান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেননি, দেখেছেন সামাজিক ন্যায্যতার পরিপ্রেক্ষিত থেকে। সামাজিক ন্যায্যতাকে তিনি একটি শোষণমুক্ত সমাজের অপরিহার্য প্রাক-শর্ত হিসেবে দেখেছেন। তিনি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন, কিন্তু দুটোকেই দেখেছেন সামাজিক ন্যায্যতার এক একটি স্তম্ভ হিসেবে। তাই সত্তর দশকের প্রথম দিকে নানা মনে ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ বিষয়ে নানা রকমের ধোঁয়াটে ভাব থাকলেও, এ বিষয় দুটোতে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল শার্সির মতো স্বচ্ছ। ‘গণতন্ত্র’কে তিনি শুদ্ধ একটি বিষয় হিসেবে ভাবেননি। ভেবেছেন, ‘সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র’ হিসেবে; আবার ‘সমাজতন্ত্র’কেও একটি যান্ত্রিক মাত্রায় দেখেননি। দেখেছেন, ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র’ হিসেবে এবং এ দুটোকেই সম্পৃক্ত করেছেন সামাজিক ন্যায্যতার সঙ্গে।
মনেপ্রাণে বাঙালি হয়েও বঙ্গবন্ধুর ছিল একটি বিস্তৃত বৈশ্বিক মানসিকতা। এ ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অনেকটা রবীন্দ্রনাথের মতো। তাই তিনি শুধু বাঙালির নেতা ছিলেন না, ছিলেন বিশ্বনেতা। বৈশ্বিক অঙ্গনে তিনি যূথবদ্ধতার পক্ষে ছিলেন, কিন্তু স্বার্থ জোটবদ্ধতার পক্ষে নয়। তাই তাঁকে দেখা গেছে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসেবে—টিটো, কাস্ত্রোর সঙ্গে একই কাতারে। বিশ্বশান্তির সপক্ষে তাঁর জোরালো বাণী, বিশ্ব শান্তি কাউন্সিলের প্রতি তাঁর সমর্থন ও মানবতাবাদী বিশ্ব ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনা তাঁকে এক বিশ্ববরেণ্য নেতায় পরিণত করেছিল। তাই তিনি শুধু ‘বঙ্গবন্ধুই’ নন, ‘বিশ্ববন্ধুও’ বটে।
শেষের কথা বলি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারের পরে ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। আমার আর হিমালয় দেখার প্রয়োজন নেই।’ আমরা অনেকেই হয়তো হিমালয় দেখেছি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি। কিন্তু তাতে কি? হিমালয়ের বিস্তার থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর বিশালতা বুঝতে পারি, তাঁর চিন্তা-চেতনা থেকে পাই এক স্থির দিকনির্দেশনা, তাঁর স্মৃতি থেকে পাই এক অনন্য প্রেরণা। প্রাপ্তি আমাদেরইবা কম কিসে? চেতনার সিঁড়ি বেয়ে আমাদের পথচলা অক্ষয় হোক।
সেলিম জাহান
ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র