প্রায় ১০ দিন পর এলাকা থেকে এলাম। গ্রামের রাস্তা দিয়ে যত্রতত্র হেঁটেছি মাইলের পর মাইল, প্রায় ৭ দিন।উন্নয়ন হয়েছে চোখে পড়ার মতো, রাস্তাঘাট প্রসারিত ও প্রলম্বিত হয়েছে। মাইলের পর মাইল রাস্তা হয়েছে উপজেলা শহর থেকে ইউনিয়নের সঙ্গে, গ্রামগঞ্জের এই রাস্তা চোখে পড়ার মতো। এটি উন্নয়নের একটি লক্ষণ, যদি কোনো সাধারণ মানুষ এই সব রাস্তাঘাটের চিত্র দেখে।
প্রাথমিক দৃষ্টিতে মনে হবে যাতায়াতব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। গ্রামের যেসব জায়গায় আগে কোনো রাস্তা ছিল না, জমির আইল ধরে হাঁটতে হতো, সেখানে এখন কাঁচা রাস্তা হয়েছে। যেখানে কাঁচা রাস্তা ছিল, সেখানে এখন ইট বিছানো রাস্তা হয়েছে।
আর ইট বিছানো রাস্তায় পিচ ঢালাই হয়েছে। এটা কয়েক বছর যাবৎ লক্ষ করা গেছে। বলতে গেলে ১৯৯৬ সালের পর থেকে যোগাযোগব্যবস্থার এ রকম উন্নতি ধারাবাহিকভাবে হয়েছে।
এখানে বলে রাখা ভালো, উন্নয়নের তিনটি পূর্ব শর্ত—প্রথমটি যোগাযোগ, দ্বিতীয়টি বিদ্যুৎ এবং তৃতীয়টি সেচ। আজকের আলোচনার বিষয় যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ে, বিশেষ করে উপজেলা শহর থেকে ইউনিয়ন ও গ্রামের যোগাযোগব্যবস্থা নিয়ে।
এখন আসি আসল কথায়, যেসব রাস্তাঘাটের কথা বললাম এগুলো সত্যি, কিন্তু সবচেয়ে বড় সত্যি, এই সব রাস্তাঘাটের একটি নমুনা দেখতে পাবেন গ্রামাঞ্চলে গেলে। এক বছর আগে আমি যখন গ্রামে যাতায়াত করেছি, তখন যেসব রাস্তা পিচ ঢালাই দেখেছি, সেই সব রাস্তায় এখন অর্ধেকের বেশি বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। স্বাভাবিক রিকশা বা অটোরিকশা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে; অর্থাৎ যোগাযোগের উন্নয়ন হয়েছে ঠিকই, উন্নয়নের টেকসই অবস্থা বজায় থাকেনি। গ্রামের মানুষ বলাবলি করছে, লোকদেখানো এই সব পিচ ঢালাই রাস্তা হয়, দুই নম্বর ইট বিছানো রাস্তা হয়, কোনোরকম নামকাওয়াস্তে মাটি দিয়ে কাঁচা রাস্তা হয়, এক বছরের মধ্যে আবার সব ধুয়ে যায়।
বলতে গেলে সবার মুখে মুখে একটি কথা—এই সব রাস্তাঘাট হয় জনসাধারণের সেবার জন্য নয়, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য নয়; বরং কিছু কিছু ব্যক্তির পকেট ভারী করার জন্য। যেসব ব্যক্তি এই সব রাস্তাঘাট করার জন্য এলজিইডি, রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ নিয়ে আসেন, তাঁরা নাকি একটি পার্সেন্টেজ হেড অফিসে দিয়ে আসেন।
যেসব করিতকর্মা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই কাজের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা একটি পার্সেন্টেজ নেন। যে ঠিকাদার কাজ পান, তিনি, সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও আশপাশের নেতাদের, পাতি নেতাদের পার্সেন্টেজ দিয়ে কাজ করতে হয়। এই সব ভাগাভাগি করতে করতে বরাদ্দ করা টাকার মোটামুটি অর্ধেক চলে যায়। তারপর যে টাকা থাকে সেখান থেকে ঠিকাদারের লাভ ও বাকি টাকার কাজ হয়।
এ রকম প্রতিটি কাজ সম্পন্ন হওয়ার দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে আবার টেন্ডার হয়, আবার সেই ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত পার্সেন্টেজ ও ভাগাভাগি হয়, এভাবেই চলতে থাকে। এ যেন একটি পিলোপাসিং গেম। সব সময় সব সরকারের আমলে এ ধরনের বাণিজ্য চলমান থাকে। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীদের এসব ছোটখাটো জায়গা তদারকি করা সম্ভব হয় না। প্রতিবছর বছর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ভিত্তিক উন্নয়ন বাজেট দেওয়া হয়। অথচ সরকারের উন্নয়ন বাজেটের এ রকম অপচয় হয়।
প্রকল্প সঠিকভাবে হয়েছে কি না, সেটা মনিটরিং করার কোনো ব্যবস্থা মনে হয় এখন পর্যন্ত কার্যকরভাবে দেখা যায় না। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগ আছে আইএমইডি, এই আইএমইডির ওপর কিছুটা দায়িত্ব পড়ে এসব মনিটরিং করার জন্য। মনে হয়, বেশির ভাগ আমজনতা এসব জানে না। আমরা কাগজে-কলমে অনেক উন্নয়নের কথা বলি, কিন্তু উন্নয়ন হয় ক্ষণিকের জন্য—এক বা দুই বছরের জন্য।
আমি প্রকৌশলী হিসেবে বলতে পারি, যদি সঠিকভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়, প্রকৌশলবিদ্যার সঠিক পরিমাপ অনুসারে, তাহলে ১০ বছর রাস্তাঘাট ভালো থাকার কথা। তাই নিজের চোখে দেখে এলাম দুই বছর আগে যে রাস্তা হয়েছে তা এখন চলার অনুপযোগী।
এবার গ্রামে একটি গল্প শুনে এলাম, একেবারেই বাস্তব গল্প। কোনো একজন করিতকর্মা ঠিকাদার রাস্তা সুন্দর করে প্রিসাইজ করেছেন, তারপর রাস্তার ওপর কালো পলিথিন দিয়ে ছবি তুলে ইঞ্জিনিয়ারকে দেখিয়ে বিল তুলে নিয়েছেন। এ ধরনের মেধাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়! ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তাঁর পার্সেন্টেজ পেলেই হলো, তদারকির কোনো বালাই নেই।
বরিশাল অঞ্চলে দেখে এলাম গ্রামেগঞ্জে যেখানে-সেখানে কালভার্ট নির্মাণ হচ্ছে। এই কালভার্টের নামে ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ নেওয়া হয়। যেখানে কালভার্টের দরকার আছে অথবা নেই, সব জায়গায় কালভার্ট হচ্ছে। ছোট্ট খালটিকে মনে হয় গলাচিপা দিয়ে সরু একটি কালভার্ট নির্মাণ করেছে। যেভাবে কালভার্ট নির্মিত হয়েছে, ওই খালের গতিপথ রুদ্ধ হয়েছে; অর্থাৎ খালটিকে প্রায় মেরে ফেলা হয়েছে। এ রকম হাজার হাজার কালভার্টের ব্যবসা চলছে।
যেসব প্রকৌশলী এসব কালভার্ট তদারকি করেন বা অনুমোদন দেন, তাঁদের আগে খালের গতিপথ ও নাব্যতার যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, তার দিকে লক্ষ রাখা উচিত ছিল। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না।
ইঞ্জিনিয়ার মহোদয় কদিন পরে ট্রান্সফার হয়ে যাবেন, তিনি তাঁর নিজের পাওনা বুঝে পেলেই হলো। ওই যে কথায় আছে না, কার গোয়াল কে দেয় ধোঁয়া!
মোটের ওপর বলতে চাচ্ছি, পিচ ঢালাই রাস্তা যেন একবার তৈরি হলে ১০ বছর চলতে পারে, ইট বিছানো রাস্তা যেন অনায়াসে ১০ বছর টিকে থাকে। সব নিয়মকানুন মেনে যে টাকা বরাদ্দ হয়, তার শতভাগ যেন এসব নির্মাণকাজে ব্যয় হয়।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি যাঁরা ওখানকার স্থায়ী বাসিন্দা, জনগণ আশা নিয়ে তাঁদের নির্বাচিত করেছিলেন, তাঁদের এসব তদারকি করার কথা, কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না।এখানে জনগণেরও কিছুটা দায়ভার আছে। সঠিক জনপ্রতিনিধি তাঁরা নির্বাচিত করতে পারেন না কেন? অবশ্য বর্তমান ব্যবস্থায় এটা খুব কঠিন একটা কাজ। তবু বঙ্গবন্ধু যে কথা বলে গিয়েছিলেন, সেই কথার প্রতিধ্বনি মনে রেখে আশা করি তাঁরা সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক জায়গায় বসাবেন।
জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে যখন আমাদের আর্থিক সংকট চলছে, বিশ্বব্যাপী মন্দা অব্যাহত, এই সময় দরকার সাশ্রয়; সঠিক দামে, সঠিক মূল্যে, সঠিক কাজটি করা। আমরা এখন আর কোনো রকম অপচয়, যত্রতত্র অপরিকল্পিত প্রকল্প নিতে পারব না—এটা মাথায় রেখে জনপ্রতিনিধি ও জনগণ উভয়েরই উচিত সঠিক
কাজটি, সঠিক দামে, সঠিক জায়গায় করা, সঠিক সময় করা।
লেখক: প্রকৌশলী