পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। দিনটি বাঙালির জীবনে আনে উৎসবের আমেজ। ধর্ম, বর্ণ, পেশা, বয়স—সবকিছুর ঊর্ধ্বে সব বাঙালিকে মিলিত করে এক মিলন মোহনায়। পুরোনো বছরের গ্লানি, জীর্ণ-জরা, দুঃখ-কষ্ট-হতাশা মুছে ফেলে পুরো জাতি জেগে ওঠে নতুন চেতনা ও নতুন ভাবোদ্দীপনায়। সাংস্কৃতিক জীবনে তো বটেই; বাঙালির আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনেও বৈশাখ গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এমন অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন উৎসব এ জাতির আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে শহর-গ্রাম সর্বত্রই আনন্দের ফল্গুধারা প্রবাহিত হলেও লোকজীবনেই প্রভাব পড়ে বেশি।
নে স্থানে বসে মেলা। আয়োজন করা হয় বিচিত্র খেলা ও নাচ-গান। বাহারি খাবারের ধুম তো আছেই। একসময় পয়লা বৈশাখে প্রজাদের সঙ্গে ভাববিনিময় করে জমিদারেরা খাজনা তুলত। কৃষিজীবী সমাজে নতুন বছরের চাষাবাদের কর্মপরিকল্পনাও হতো এদিন থেকে। এখন প্রচলিত আছে ব্যবসায়ীদের হালখাতা। জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত হওয়ায় বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির নান্দনিক ভাবনায় বৈশাখ স্থান করে নিয়েছে অনিবার্যভাবে। মধ্যযুগের কবি বৈশাখের অনলসম খরার স্বরূপ বর্ণনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ভাবের গভীরতায় বৈশাখকে স্বাগত জানিয়ে কবিতা লিখেছেন। বাঙালির আত্মপরিচয় সন্ধান এবং জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও পরিপুষ্টি সাধনে বৈশাখ ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। বৈশাখের চণ্ডমূর্তি ও প্রতিবাদী ভাবোদ্দীপনায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দুঃশাসনের আসন টলে দিয়েছে। আর সে জন্যই তারা ও তাদের উত্তরসূরিরা বারবার এর টুঁটি চেপে ধরতে চেয়েছে এবং বৈশাখী চেতনা বিনাশে কাজ করেছে।
সাতচল্লিশের দেশভাগের পর মুসলিম লিগ সরকার চাঁদ-তারার নিশান হাতে ধর্মের বাতাবরণে আরবি-ফারসি বুলি আউড়িয়ে পাকজমিন কাজ শুরু করে। এই কাজ করতে গিয়ে তারা আঘাত হানে বাঙালির ভাষা, সাহিত্য ও চিরায়ত সংস্কৃতির ওপর। শুধু তা-ই নয়, ইসলামি ভাবধারায় পাকিস্তানি তমদ্দুন প্রতিষ্ঠায় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে; উচ্চকণ্ঠে সুর ধরেছে, ‘পাকিস্তানের গুলিস্তানে আমরা বুলবুলি...’। বাংলা ভাষাকে মুসলমানি জবান করার বহু রকম অপপ্রয়াস চালিয়েছে। বাঙালি-সংস্কৃতির ওপর তারা এভাবে যতই চড়াও হয়েছে, বাঙালিত্বের বন্ধনও ততই অটুট ও দৃঢ় হয়েছে। পাকিস্তানি ভাবধারার বিপরীতে বাঙালিত্বের এই জাগরণে পয়লা বৈশাখ নব-উদ্দীপনা নিয়ে হাজির হয়েছে।
একাত্তরের অবরুদ্ধ পরিবেশে বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ পালনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। সত্তরের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পরেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে অসহযোগ আন্দোলন এবং পরে স্বাধীনতার ডাক দেন। সাতই মার্চের ভাষণে তিনি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান জানান এবং পঁচিশে মার্চ গভীর রাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এমন দুঃসহ পরিবেশের মধ্যে আসে বাংলা নববর্ষ।
এ বছর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পয়লা বৈশাখের ছুটি বাতিল করে। ঢাকাসহ সারা দেশে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরদের হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজের ভয়াবহ পরিবেশে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা তৈরি হয়। পুরো দেশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পয়লা বৈশাখকেও করা হয় অবরুদ্ধ। কেমন ছিল একাত্তরের সেই ভয়াবহ দিনের পয়লা বৈশাখ? জানা যাক শহীদজননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ থেকে, ‘আজ পয়লা বৈশাখ। সরকারি ছুটি বাতিল হয়ে গেছে।
পয়লা বৈশাখের উল্লেখমাত্র না করে কাগজে বক্স করে ছাপানো হয়েছে: আজ বৃহস্পতিবার প্রাদেশিক সরকারের যে ছুটি ছিল, জরুরি অবস্থার দরুন তা বাতিল করা হয়েছে। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে ঢাকা শহরে এবং দেশের সর্বত্র বর্ষবরণ অনুষ্ঠানও বন্ধ। কিন্তু সে তো বাইরে। ঘরের ভেতরে, বুকের ভেতরে কে বন্ধ করতে পারে?’ পয়লা বৈশাখকে নাগরিক জীবনে তথা সর্বময় বিস্তৃত করার উদ্যোক্তা সন্জীদা খাতুনও সেদিনের স্মৃতিচারণা করে বলেছেন: ‘একাত্তরের এপ্রিল মাস। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলছে। ঢাকা শহরের ঘরে ঘরে তখন শোক আর সন্তাপে বুকচাপা কান্না। একাত্তরের পয়লা বৈশাখে কোনো গান বাজেনি রমনার বটমূলে। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এমন কখনো হয়নি।’
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৭১ সালের পয়লা বৈশাখ ছুটি বাতিল করে বাংলা নববর্ষ বরণ করতে না দিলেও বাঙালির অস্তিত্ব থেকে একে মুছে ফেলতে পারেনি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা এবং বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিজগতের মানুষদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও বৈশাখী চেতনা তথা অসাম্প্রদায়িক মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে দেশকে যেমন স্বাধীন করেছে, তেমনি অবরোধ মুক্ত করেছে তাদের প্রিয় উৎসব বাংলা নববর্ষ তথা পয়লা বৈশাখকে।
পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের প্রেতাত্মারা ফতোয়া দিয়ে, ভয়ভীতি প্রদর্শন করে, বোমা মেরে বন্ধ করতে চেয়েছে এই উৎসব, কিন্তু পারেনি। বহু শতাব্দীর ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার এ উৎসব বাঙালির জীবনে এসেছে আরও ব্যাপক, বিস্তৃত, সর্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা অবিনাশী বার্তাবাহক হিসেবে। পুরোনো বছরের আবর্জনা দূর করে, নতুনের কেতন উড়িয়ে পয়লা বৈশাখ বারবার হাজির হয় বাঙালির জীবনে। থাকবেও চিরকাল। সাম্প্রদায়িকতার বিনাশে, জাতির অগ্রগতি ও সম্প্রীতির ধারক-বাহক হিসেবে বৈশাখী চেতনা থাকবে চির-জাগরূক হয়ে।