প্রায় কাছাকাছি সময়ে যে তিনটি আজব ঘটনা ঘটে গেল, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে। তিনটি বিষয়েই হিন্দুসম্প্রদায়ের তিনজন মানুষ হয়েছেন আক্রমণের শিকার। ঘটনার ভেতরের ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর দেখা গেল, দুটো ঘটনা একেবারে স্থানীয় স্কুল-রাজনীতি, মোবাইল ফোন হাতে অকালপক্ব শিক্ষার্থীর দুর্বিনীত আচরণ এবং সমাজে ছড়িয়ে যাওয়া বিদ্বেষেরই সরল অনুবাদ। এটাকে আমার সম্প্রদায়গত আক্রমণ মনে হয়নি। কিন্তু ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে মানুষের মনে ভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে যে অসহিষ্ণুতার সৃষ্টি হয়েছে, তার আভাস পাওয়া যাবে।
এক.
পুলিশ কনস্টেবল নাজমুল তারেকের কথা দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি রাজধানীর ফার্মগেটে সনাতনধর্মীয় নারী শিক্ষক লতা সমাদ্দারকে টিপ পরার কারণে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছেন। এটাই ঘটনা। পরবর্তীকালে তিনি নিজের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন বলে যে বয়ান দিয়েছেন, তা যে বানোয়াট, সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে সিসিটিভি। তাঁর কর্মকাণ্ড একটু তলিয়ে দেখা যাক–
১. ছিলেন মোটরসাইকেলে। মাথায় হেলমেট ছিল না। ছিল টুপি। পুলিশ সদস্য হয়ে তিনি হেলমেট না পরে আইন ভেঙেছেন। এভাবে টুপি পরে তিনি পুরো পথ পাড়ি দিয়েছেন, তাঁকে কোনো ট্রাফিক পুলিশ আটকায়নি, কোনো জরিমানা দিতে
হয়নি তাঁকে।
২. তিনি খুবই ধর্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। যার জন্য স্মার্টফোন নেই তাঁর হাতে, তিনি টিভি দেখেন না। অথচ নারী বা অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ পুষে রাখেন মনে। তিনি প্রকাশ্য রাস্তায় মোটরসাইকেলে বসে একজন নারীকে টিপ পরার ‘অপরাধে’ প্রকাশ্যে গালাগাল করতে পারেন।
৩. এবং সানন্দে মিথ্যে কথা বলতে পারেন। মোটরসাইকেলে করে সাতসকালে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছিলেন, এ রকম মিথ্যে কথা অবলীলায় বলতে পারেন। জোশ বজায় থাকলেও তা সত্য হয় না। তিনি হয়তো ভাবতেও পারেননি, রাস্তার সিসিটিভিগুলো তাঁর চেয়ে বেশি সত্যবাদী। তারা গুমর ফাঁস করে দিয়েছে। সেদিন তাঁর স্ত্রী ছিলেন না মোটরসাইকেলে।
দুই.
মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে নিয়ে যে ঘটনাটি ঘটেছে, তা সুপরিকল্পিত। তিনি এলাকার একজন নামী বিজ্ঞান শিক্ষক। তাঁর কাছে প্রাইভেট পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনেক। ক্লাস টেনের যে শিক্ষার্থীটি মোবাইলে কথোপকথন রেকর্ড করেছে, তার অভিসন্ধি বোঝা কঠিন কিছু নয়। বিজ্ঞান ক্লাসে ধর্ম নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করেছে যে ছাত্ররা, তাদের ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষ কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। এটা তো সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। এটা অপরাধ। এ ধরনের অপরাধ হঠাৎ করে ঘটানো যায় না। ক্লাসরুমে স্মার্টফোন নিয়ে যাওয়াও অন্যায়। এ ধরনের কাণ্ড ঘটাতে পূর্বপ্রস্তুতি লাগে। আর তাতে প্রমাণিত হয়, পরিকল্পিতভাবেই তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এদের মানসিক ধরন বিবেচনা করে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো উচিত কি না, তা নিয়ে ভাবা উচিত সংশ্লিষ্ট মহলের।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, রেকর্ড করা ভাষ্য অতিদ্রুত প্রচার করে শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে ঝটিকা জনমত গঠন করে তাঁর জীবন বিপন্ন করে তোলা হয়েছে। যারা এই অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত, তারা ধর্মীয় সুড়সুড়িও দিয়েছে। আর ধর্মীয় সুড়সুড়িতে অন্য একটি অংশের ‘অনুভূতি’তে আঘাত লেগেছে। ‘কান নিয়েছে চিলে’, তাই চিলের পেছনে দৌড়াতে শুরু করেছে তারা। অকথ্য ভাষায় এই শিক্ষককে গালাগাল করা শুরু হয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পুলিশ হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছিল। ১৯ দিন পর গতকাল তাঁর জামিন মঞ্জুর হয়েছে।
কিন্তু এই ঘটনার ফলে দেখা যাচ্ছে, কিছু ভণ্ড, নীতি-নৈতিকতাবিবর্জিত মানুষের কারণে দেশের সব মুসলমানকে বিব্রত হতে হচ্ছে। এর দায় সেই মানুষগুলোরই, কিন্তু তারা এমনভাবে ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে, যেন মনে হচ্ছে এটা হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানের যুদ্ধ। কিন্তু ভণ্ড কিছু মানুষের ঘটানো এই দুর্বৃত্তপনার দায় সব মুসলমান নেবে কেন? এ দায় আমাদের ভাবনা-জগতেরও। কূপমণ্ডূক হওয়ার সব ধরনের আয়োজন এরই মধ্যে সুসম্পন্ন হয়েছে। যুক্তিহীন, অন্ধবিশ্বাসনির্ভর একটা সমাজ গড়ে উঠছে, যাদের হৃদয়ে ঘৃণা, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িকতার চাষবাস হচ্ছে।
বিজ্ঞান ক্লাসে যখন কিছু অর্বাচীন ছাত্র বিজ্ঞান ও ধর্ম নিয়ে তর্ক করছিল, তখনই ধমক দিয়ে তাদের থামিয়ে দিতে পারতেন হৃদয় মণ্ডল। কিন্তু তিনি সেটা না করে আলোচনা করতে গেছেন। আমার প্রশ্ন, ক্লাসে অনৈতিকভাবে যা রেকর্ড করা হলো, সেই রেকর্ডের কোন কথাটাকে ধর্মের অবমাননা হিসেবে দেখা হয়েছে? কেন তা ধর্মের অবমাননা? এভাবে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে যদি ভাবনাজগৎ গড়ে উঠতে থাকে, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের যা কিছু অর্জন, তা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। আসলে, বহু কিছুই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। যা টিকে আছে, তার ভিত্তিটাও হয়ে গেছে নড়বড়ে। এ কারণেই ধর্মকে পুঁজি করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করে নিতে পারছে দুর্বৃত্তরা।
নওগাঁয় হিজাব পরার কারণে প্রহার করা নিয়ে কতিপয় ছাত্রী যে মিথ্যে রটিয়েছিল, তাকে কাজে লাগিয়েছে এলাকারই কিছু মানুষ। স্কুল-রাজনীতির শিকার হতে হলো আমোদিনী পালকে। তাঁর ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেল, সে দায় কে নেবে? কোমলমতি ছাত্রীরা যে একের পর এক মিথ্যে বলে গেল, সে মিথ্যা বলার শিক্ষা তারা পেল কোথায়? হিজাব পরা নিয়ে বিতর্ক উসকে দিতে পারলে সেটা যে মুসলমান সম্প্রদায় লুফে নেবে, সে কথা তারা কাদের কাছ থেকে জানল? কিংবা কারা তাদের বিপথে চালিত করল? তাদের খুঁজে বের করা দরকার।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, স্কুলড্রেস না পরে আসায় স্কুলের ছেলেদের মৃদু আঘাত করেছেন শরীরচর্চা শিক্ষক বদিউল আলম, মেয়েদের মৃদু আঘাত করেছেন আমোদিনী পাল। পুরো ঘটনাটিকে এমনভাবে সাজানো হলো, যেন আমোদিনী পাল হিজাব না পরায় পিটিয়েছেন ছাত্রীদের। ছাত্রীরা বানিয়ে বানিয়ে তাঁর হিজাববিরোধী সংলাপেরও বয়ান দিল! দ্রুত সে খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাষ্ট্র করে দেওয়া হলো।
এরপর বেরিয়ে এল থলের বিড়াল। প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণের চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী মে মাসে, তাঁর কিছু অনিয়মের ব্যাপারে জানতে চাইবেন পরবর্তীকালে প্রধান শিক্ষক পদে আসীন হবেন যিনি, সেই আমোদিনী পাল—এ রকম একটি আশঙ্কা থেকে কেউ কেউ আমোদিনী পালকে হেনস্তা করার সুযোগ নিতে চেয়েছেন বলে অনুমান করা যায়। হিজাব না পরায় পেটানো হয়েছে বলে যে কথা রটানো হয়েছে, তা যে একেবারেই বানোয়াট, তার একটা প্রমাণ হলো, পিটুনি খাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র এবং সনাতন ধর্মের অনুসারী মেয়েরাও ছিল। আমোদিনী পাল কি হিন্দু মেয়েদেরও মেরেছেন হিজাব না পরার কারণে?
চার.
ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন। কিন্তু কোনো একটি অদৃশ্য সুতো দিয়ে আবার জোড়া লাগানোও। আমাদের রাজনীতি থেকে সংস্কৃতিকে আলাদা করে দেওয়ার কাজটি ঘটে গেছে সবার অজ্ঞাতে। ফলে রুচিবোধ, যৌক্তিক অবস্থান, প্রগতির সঙ্গে থাকা, দেশপ্রেম, পরমতসহিষ্ণুতা, ঐতিহ্যবাহী উৎসব, অসাম্প্রদায়িকতাও হয়ে উঠেছে প্রশ্নবিদ্ধ। এই খালি জায়গা ভরাট হয়েছে কূপমণ্ডূকতা দিয়ে। শুধু কি কূপমণ্ডূকতা? দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িকতাও সঙ্গী হয়েছে তার। বদলে গেছে স্কুলের বই। পাড়ায়-মহল্লায় এখন আর বুদ্ধিদীপ্ত আড্ডা হয় না। হয় না সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মানুষ ক্রমেই ধর্মীয় বিশ্বাসে একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে।
করোনা নিয়ে বিভ্রান্তিকর ওয়াজগুলোর কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে পড়ে যাবে। ইউটিউব, ফেসবুকে এই ওয়াজগুলো খুবই জনপ্রিয়। সমস্যা হলো, ওয়াজগুলো বিশ্বাস করে নিজের মনোজগৎ গড়ে নেয় অনেকে। কোনো কোনো ওয়াজে অন্য ধর্ম সম্পর্কে যে বিষোদ্গার করা হয়, নারীর প্রতি যে ঘৃণা ছড়ানো হয়, সেটা অনেকের মনে ব্যাধির মতো জমাট বাঁধে। তখনই সে ভিন্ন ধর্ম অথবা নারীবিদ্বেষী হয়ে ওঠে। এই তালিকায় শুধু পুরুষ নন, পুরুষদের শেখানো বুলিতে মগজ ধোলাই হওয়া নারীরাও রয়েছেন।
কিন্তু এটা শুধু ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কারণেই ঘটছে—এমন নয়। যে অঙ্গীকার বুকে নিয়ে একটি নতুন দেশ গড়া হয়েছিল, তার প্রতিটি স্তম্ভই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। রাজনীতিতে অনৈতিকতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জগতে অগভীরতা, অর্থনৈতিক জগতে বিনা পুঁজিতে কোটিপতি হওয়ার সাধনা ইত্যাদি বুঝিয়ে দেয়, ক্ষয়টা আসলে সামগ্রিক। এর দায় রাজনীতিবিদেরা তো বটেই, অন্য কোনো পেশার মানুষও এড়াতে পারেন না। আর পরিবার এবং বিদ্যায়তন থেকে কী শিখছে একটা শিশু, সেটা দেখলে বোঝা যাবে, এই সর্বগ্রাসী ধ্বংসের শুরুটা কোথায়।
তাই এই সমাজে একজনই বিভ্রান্ত নাজমুল তারেক আছেন, একজন হৃদয় মণ্ডলই একদল বিপথগামী নিগৃহীত হবেন, একজন আমোদিনী পালকেই হতে হবে স্কুল-রাজনীতির শিকার—এমন নয়। যেকোনো সময় যেকোনো ধর্মের যেকোনো মানুষ সখাত সলিলে নিমজ্জিত হতে পারেন। উদাহরণ? বেশি দূর যেতে হবে না, এই তিনটি ঘটনার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্যগুলো পড়ে দেখুন। কেউ যাচাই-বাছাইয়ের ধার ধারেনি, সমানে হিন্দুসম্প্রদায়ের তিনজন ব্যক্তিকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে গেছে। এগুলো সহ্য করতে থাকলে এই গালাগালের আঘাত আপনাকেও কাবু করে ফেলবে—এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা