বাঙালির রয়েছে প্রায় ৪ হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস, স্বকীয় ঐতিহ্য ও স্বতন্ত্র সংস্কৃতি। মূলত দক্ষিণ এশিয়ার লোকেরাই ধরে রেখেছে বাঙালি সংস্কৃতি। যার মধ্যে বাংলাদেশ, আসাম, ত্রিপুরা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম।
আমাদের দেশের একমাত্র প্রধান ও দাপ্তরিক ভাষা বাংলা। শুধু নিজস্ব ভাষাই নয়, বাঙালির রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। যার বলে বাঙালি বরাবরই বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে স্বাধীন ও সাহসী জাতি হিসেবে। পৃথিবীর বুকে মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতা অর্জনের গৌরবও কেবল আমাদের দেশের বাঙালিদেরই রয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন করার পেছনে অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্রের স্বাধীনতা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। সংস্কৃতির স্বাধীনতা। তবে আমরা হয়তো স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসে এখন আবার হারিয়েছি কথা বলার স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে চলার স্বাধীনতা। তাই নয় কি? একটু ভাবলে নিজেরাই এর উত্তর পেয়ে যাব।
সংস্কৃতি বলতে আসলেই কী বোঝায়? কতটুকু বুঝি আমরা? বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অংশ হিসেবে খাবারে মাছ আর ভাত, পোশাকে শাড়ি আর পাঞ্জাবি, বারো মাসে তেরো পার্বণ, পয়লা বৈশাখ, চৈত্রসংক্রান্তি, বর্ষাবরণ, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি আর ধর্মীয় অনুষ্ঠান তো রয়েছেই। তবে বাঙালি বিশ্বাস করে ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। সভ্য জাতির জন্য সংস্কৃতির সংজ্ঞা আরেকটু গভীর হওয়া উচিত। সংস্কৃতি শুধু আমাদের পোশাক, খাবার আর উৎসবে নয়। আসল সংস্কৃতি তো আমাদের মূল্যবোধে। আমাদের চেতনায়। আমাদের আত্মসম্মানে।
একজন সংস্কৃতিমান মানুষের কাছে সবার আগে তাঁর আত্মসম্মানবোধ। তাঁর মূল্যবোধ। তাঁর চেতনা। তাঁর বিবেকবোধ। যে বিবেকবোধ তাঁকে সব ধরনের অসৎ কাজ থেকে দূরে রাখে। কোনো অসৎ কাজের চিন্তা করলেও যে বিবেকবোধ তাঁকে দংশন করে। আমাদের কি আছে এমন সংস্কৃতি? নাকি এখনো সংস্কৃতিকে আমাদের শৈশবের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাঝেই বেঁধে রেখেছি?
যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে এখন সময় এসেছে সংস্কৃতি বদলানোর। সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গেছে—এই অভিযোগ দিয়ে প্রকাশ্যে কোনো মেয়েকে গালিগালাজ করে তার গায়ে হাত তোলার সংস্কৃতি তো জাহেলিয়া যুগে ছিল। এ যুগে এসে তা আর মানায় না।
একজন নারী কি পোশাক পরবেন, তা নিয়ে নাক না গলানোই সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ করে। আর যদি তা সংস্কৃতিবহির্ভূত হয়, তাহলে কি প্রকাশ্যে কাউকে গালিগালাজ করা, গায়ে হাত তোলার অধিকার দেয় সেই সংস্কৃতি?
এবার নিশ্চয় বলবেন, ইসলাম ধর্ম নারীর পোশাক নিয়ে কী বলেছে? তাদের বলি, ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম ধর্মের কোথাও গালিগালাজ, মারামারিকে সমর্থন জানানো হয়নি। আমাদের সমাজ যদি ধর্ম নিয়ে সত্যিই চিন্তিত থাকত, তাহলে ৪০ বছরের শিক্ষক যখন ২৫ বছরের ছাত্রকে বিয়ে করে হালাল সম্পর্ক স্থাপন করেন, তখন সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে বিয়েটাকে লুকিয়ে রাখতে হতো না। আর যখন জানাজানি হলো, তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় বুলিং, হেনস্তা ছাড়া আর কিছু করেছে এই সমাজ? শেষ পরিণতি শিক্ষিকার মৃত্যু। তখন সমাজ কেন বলেনি ধর্মের কথা?
প্রয়োজনে ধর্মকে টেনে এনে ধর্মের ব্যবসা করা বন্ধ করা জরুরি। এতে কেবল নিজ ধর্মকে ছোট করা হয়, আর কিছু নয়। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ, মানবতার দেশ। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নাগরিকদের জায়গা না হলেও আমাদের এই ছোট্ট ভূখণ্ডে আমরা তাদের জায়গা দিয়েছি। এতে আমাদের উদারতা নিয়ে আর কিছু বলার অপেক্ষা থাকে না। তারপরও ছোট ছোট বিষয়কে আমরা এমনভাবে উপস্থাপন করে নিজেকে প্রাচীনকালের শিকড়ে বেঁধে রেখেছি, যখন বিশ্ব অনেক বড় কোনো সফলতা খোঁজ করছে; অর্থাৎ আমরা যখন বালিশের জন্য তুলা কতটা দরকার, এটি নিয়ে ভাবছি, তখন কেউ মঙ্গল গ্রহে ঘর বানানোর চিন্তা করছে। কী নেই আমাদের? একটি সাহসী জাতি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে তার উপস্থিতি জানান দেবে, এটিই কাম্য।
লেখক: সাংবাদিক