নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচন জমে উঠেছে। আগামী ১৬ জানুয়ারি এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে না থাকলেও দলের একজন সিনিয়র নেতা সম্মিলিত নাগরিক জোটের ব্যানারে প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে কিছুটা ভিন্ন মেজাজ ও মাত্রা এনে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি আগেও মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে বিরোধ আছে। পুরো দল এককাট্টা হয়ে আইভীর পক্ষে ভোটের লড়াইয়ে না থাকার আশঙ্কা আছে। স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমান বরাবরই আইভীর বিরুদ্ধে। তাঁদের এই বিরোধ কোনো গোপন বিষয় নয়। সবাই জানেন। দলের হাইকমান্ডের কাছেও বিষয়টি অজানা নয়। আগের দুই নির্বাচনেও শামীম ওসমানের বিরোধিতা মোকাবিলা করেই জয়ী হয়েছিলেন আইভী। নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের যেমন প্রভাব আছে, তেমনি আইভীও উড়ে এসে জুড়ে বসা কেউ নন। আইভীর বাবা আলী আহমেদ চুনকাও নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের একজন ত্যাগী ও জনপ্রিয় নেতা ছিলেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদ আইভী বঞ্চিত হননি। এবারও একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীকে বিজয়ী করতে নেতা–কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘প্রার্থী অনেকেই ছিলেন, কিন্তু একজনকে যেহেতু মনোনয়ন দিতে হয়, তাই আমি আইভীকে দিয়েছি। আইভী নৌকার প্রার্থী, সবাই নৌকার বিজয়ে কাজ করবেন, এটাই আমি চাই।’ দলীয় প্রধানের এই আকাঙ্ক্ষা পূরণে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ এক হয়ে কাজ করবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে শামীম ওসমানকে এখনো আইভীর পাশে দেখা যায়নি। শামীম তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করবেন, তেমন কোনো আলামত এখনো নারায়ণগঞ্জে ভোটারদের সামনে দৃশ্যমান হয়নি।
আওয়ামী লীগ ও নৌকার প্রধান প্রতিপক্ষ সাধারণত ভাবা হয় বা ধরা হয় বিএনপি বা ধানের শীষকে। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে বেনামে বিএনপি আছে, কিন্তু ধানের শীষ নেই। তবে আওয়ামী লীগবিরোধী সব শক্তি এক হয়ে নারায়ণগঞ্জে আইভী তথা নৌকার জয় আটকে দিতে চাইছে বলে একধরনের প্রচারণা চলছে। নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা পরিবর্তন চান, নাকি আইভীর প্রতি তাদের আস্থা-বিশ্বাস অটুট আছে, তা প্রমাণ হবে ভোটের দিন। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ ও কৌতূহল বেড়েছে। এমনও মনে করা হচ্ছে, নাসিক নির্বাচন পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের একটি মহড়া হিসেবে গণ্য হতে পারে। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে যাঁরা লড়ছেন, তাঁদের সবাই জয় পাচ্ছেন না। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ। নারায়ণগঞ্জে যদি নৌকার প্রতিপক্ষ বিজয়ী হয়, তাহলে সেটা আওয়ামী লীগের জন্য ভালো বার্তা দেবে না, কিন্তু আওয়ামী লীগবিরোধীদের নৈতিক শক্তি বাড়াতে সহযোগিতা করবে।
আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকে প্রার্থী নিয়ে ভোটের মাঠে থাকলেও আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে নেই বিএনপি। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে কেন্দ্র থেকে স্পষ্ট ঘোষণা দিলেও দলটির স্থানীয় নেতারা নেমেছেন ভোটযুদ্ধে। মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন বিএনপির পরিচিত মুখ তৈমূর আলম খন্দকার। বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত অনেকেই কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় যাঁদের নাম রয়েছে তাঁরা সবাই যদি শক্তভাবে মাঠে থাকেন, তবে মেয়র পদে আইভীর সঙ্গে তৈমূর আলমের লড়াই শেষ মুহূর্তে জমে উঠবে। নাসিক নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রহ পোষণ করে ফরম তুলেও শেষ পর্যন্ত সরে দাঁড়িয়েছেন বিএনপির সাবেক এমপি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন, মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান ও মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামাল। গত বুধবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন তাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দেননি।
সে ক্ষেত্রে নাসিক নির্বাচনে একক প্রার্থী (স্বতন্ত্র) হিসেবে মাঠে আছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তৈমূর আলম খন্দকার। সম্মিলিত নাগরিক জোটের মেয়র প্রার্থী হচ্ছেন এমন আভাস দিয়ে তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, ২৭ ডিসেম্বর প্রতীক পাওয়ার পর সবকিছু দেখতে পাবেন। তাঁর দাবি, ‘আমি শুধু বিএনপির প্রার্থী না, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ সব দলের সমর্থন রয়েছে আমার প্রতি।’ আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক আহ্বায়ক, নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় নেতা এস এম আকরাম এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারকে সমর্থন দেওয়ায় ভোটের মাঠে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির একাংশের প্রকাশ্য ও গোপন ভূমিকা ভোটের অঙ্কে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন।
আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী বর্তমান মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারসহ ছয়জনের প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে দুজনের প্রার্থিতা। জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত বাছাই অনুষ্ঠানে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। অন্যান্য বৈধ প্রার্থীর মধ্যে আছেন খেলাফত মজলিসের মেয়র প্রার্থী এ বি এম সিরাজুল মামুন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থী জসিম উদ্দিন, ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মাওলানা মাসুম বিল্লাহ ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির প্রার্থী রাশেদ ফেরদৌস।
আওয়ামী লীগ এবং নৌকার নিজস্ব ভোটব্যাংক যেমন আছে, তেমনি আইভীরও নিজের জনপ্রিয়তা আছে। আইভী মানুষের মধ্যে থেকে কাজ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বড় কোনো অভিযোগের কথাও শোনা যায় না। অন্যদিকে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েও মানুষের মধ্যে উৎসাহ আছে, তেমন শোনা যায় না। তৈমূর আলম খন্দকার দলের অপ্রকাশ্য সমর্থন নিয়ে কতটা অগ্রসর হতে পারবেন, দেখার বিষয় সেটাও।
১৯ ডিসেম্বর বিকেলে বন্দরের কদমরসুল দরগায় জিয়ারতে গিয়ে তৈমূর আলম খন্দকার নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, এই সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে এই নির্বাচন। যদি এই নির্বাচনে সরকার কারচুপি করে তাহলে এই নারায়ণগঞ্জ থেকেই শুরু হবে সরকার পতনের আন্দোলন। সরকার পতনের এমন আন্দোলনের কথা বিএনপির শীর্ষ নেতারাও অনেক বলেছেন, মানুষ এসব কথায় খুব গুরুত্ব দেয় বলে মনে হয় না। এদিকে আচরণবিধি ভঙ্গ করে প্রতিদিনই তৈমূর আলম ধর্মীয় উপাসনালয়ে ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠছে। প্রতীক পাওয়ার পর নির্বাচনী প্রচারণা আরও জমজমাট হয়ে উঠলে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার সব দিক সামাল দিয়ে পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে রাখতে পারেন কি না, দেখতে হবে সেটাও। যেহেতু দলীয়ভাবে বিএনপি নির্বাচন করছে না, সেহেতু দলের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত হয়ে তৈমূর আলম খন্দকারের পক্ষে ভোট চাইলে সেটা নীতিগতভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
নাসিকের টানা দুবারের মেয়র আইভীও এই নির্বাচনকে সহজভাবে নিচ্ছেন বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। বাইরের প্ররোচনার বিষয়ে তৈমূরকে সতর্ক করে আইভী বলেছেন, ‘আপনি আমার বাবার শিষ্য ছিলেন, এখন চাচা-ভাতিজি নির্বাচন করব, তাতে অসুবিধা কোথায়। ১৬ জানুয়ারি জনগণ রায় দিয়ে তাঁদের মেয়র নির্বাচন করবেন।’ তিনি বলেছেন, ‘২০০৩, ২০১১, ২০১৬ সালে নির্বাচন যেভাবে সুষ্ঠু হয়েছে, আশা করি আগামী ১৬ জানুয়ারির নির্বাচনও নিরপেক্ষ হবে।’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, নারায়ণগঞ্জে বিএনপির তৈমূর আলমের নিজস্ব ইমেজ রয়েছে। আছে দলীয় ভোটও। কিন্তু ধানের শীষ প্রতীকবিহীন তৈমূর ভোটের মাঠে কতটা শক্ত প্রার্থী—সময় গড়ালে তা বোঝা যাবে। আবার নাসিকের প্রথম নির্বাচনে ভোটের কয়েক ঘণ্টা আগে নীরব আত্মসমর্পণের ঘটনায় ভোটের মাঠে তাঁর প্রতি আস্থা-অনাস্থার হিসাব রয়েছে।
নাসিক নির্বাচনের ফলাফল রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দিতে পারে বলে যাঁরা আশা করছেন, তাঁদের জন্য কোনো সুখবর অপেক্ষা থাকতে পারে–এমন ভবিষ্যদ্বাণী দেওয়ার মতো রাজনৈতিক গণক কেউ আছেন বলে মনে হয় না।
বিভুরঞ্জন সরকার,সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা