হোম > ছাপা সংস্করণ

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশের দুগ্ধ খাত

শাইখ সিরাজ

বাংলাদেশের প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয় গুঁড়ো দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য আমদানি করতে। অথচ ১৯৭৩-৭৪ সালেই সরকারিভাবে এই খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমরা আমাদের চাহিদার ২০ শতাংশও উৎপাদন করতে পারছি না। আমাদের দেশে দুগ্ধ খাত বিকশিত না হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে; যার মধ্যে অন্যতম কারণ আমরা বোধ হয় আমদানি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। না হলে, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদনব্যবস্থাকে উন্নত করার বিষয়টিকে কেন আমরা আমলে আনছি না।

গত শতকের আশির দশকের প্রথম দিকে গ্রামগঞ্জে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কৃষক তাঁর বাড়িতে একটা-দুইটা গরু-গাভি পালতেন। দেশি জাতের গাভি বলে দিনে সর্বোচ্চ দেড়-দুই লিটার দুধ পেতেন। সেখান থেকে যে দুধ পাওয়া যেত, কৃষক তা নিজের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি গ্রামের বাজারে বিক্রি করতেন। ধানের খড় আর মাঠের ঘাস খাইয়ে দু-একটা গরু লালনপালন করতে খুব একটা খরচ হতো না। কিন্তু আমরা উৎসাহিত করলাম বিদেশি জাতের সঙ্গে সংকরায়িত উন্নত গাভি লালনপালনের। বেশি দুধ পাওয়া যাবে ভেবে কৃষক সেই গাভি পালন শুরু করলেন। কিন্তু উন্নত জাতের গাভির খাবার খরচ বেশি। নিজের পরিবারের খাবার জোগাতে হিমশিম খাওয়া কৃষকের পক্ষে গাভির খাবার জোগানো কষ্টকর হয়ে পড়ল। নিজে খেয়ে না খেয়ে গাভিকে খাইয়ে লালনপালন করে যখন ১৫-২০ লিটার দুধ নিয়ে বাজারে গিয়ে দেখলেন দুধের কাঙ্ক্ষিত দাম নেই, কৃষক অভিমানে দুধ ফেলে দিয়েছেন। ফলে আমাদের দুগ্ধ খাত আর প্রত্যাশিতভাবে বিকশিত হয়নি।

যেকোনো কিছু উৎপাদনের আগে দুটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হয়। প্রথমটি বাজার ব্যবস্থাপনা। আমার উৎপাদিত পণ্যটির বাজার তৈরি আছে কি না, আমি কী পরিমাণ বিক্রি করতে পারব, সে বিষয়টি মাথায় রেখেই উৎপাদনে যাওয়া উচিত। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, উৎপাদিত পণ্যটি সংরক্ষণ করতে পারব কি না। বাজারে দর না পেলে কিংবা বিক্রি করতে না পারলেও অন্য বাজারে বিক্রির জন্য আমি সেটা কত দিন সংরক্ষণ করতে পারব, সে বিষয়টিও ভাবনায় রাখতে হয়। দুধ পচনশীল পণ্য। খামারি যখন তাঁর উৎপাদিত দুধ কাঙ্ক্ষিত দরে বিক্রি করতে পারেন না, তখন তাঁকে বাধ্য হয়েই লোকসান হলেও কম দামে বিক্রি করে দিতে হয়। আমরা দুধের উৎপাদন বাড়ানোর কাজটি শুরু করলেও একই সঙ্গে দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণের কাজটি করিনি বা করতে পারিনি।

ভারতের আমুল আর বাংলাদেশের মিল্ক ভিটা দুটি প্রতিষ্ঠানের জন্মের ইতিহাস প্রায় একই সময়ে হলেও আমুল সারা ভারত তো বটেই, সারা বিশ্বেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আর আমরা আমাদের দেশের বাজারই দখলে নিতে পারছি না।

১০০ গরুর মাঝে কোনো নির্দিষ্ট গরুকে চেহারা দেখে আলাদা করা যাবে কি? নিশ্চয়ই না। আমাদের কাছে সব গরুই আদতে দেখতে একই রকম। শুধু রঙের ও আকারের পার্থক্য দেখে আমরা গরুকে আলাদা করতে পারব। কিন্তু আধুনিক যন্ত্র ঠিকই গরুর মুখে ক্যামেরা ধরে বলে দিতে পারে গরুর নম্বর কত, গরুর শারীরিক অবস্থা কেমন, কী পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করেছে। প্রযুক্তি, বিশেষ করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) এবং আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) উৎপাদনব্যবস্থাকে নিয়ে যাচ্ছে অবিশ্বাস্য রকম এক প্রান্তে; যা কিছুদিন আগেও ছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, আজ তা চরম বাস্তব। একা একজনের পক্ষে একটি বিশাল খামার পরিচালনা করা কঠিন কাজ নয়।

২০১৫ সালে নেদারল্যান্ডসের ডো মার্কে গরুর খামারে গিয়ে অবাক হয়েছিলাম। আধুনিক প্রযুক্তির বিস্ময়কর ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছিল গরুর খামার নয়, যেন কোনো এক শিল্পপ্রতিষ্ঠানে চলে এসেছি। ইন্টারনেট অব থিংস বা আইওটি কৃষিতে যে বৈপ্লবিক রূপান্তর আনতে যাচ্ছে, এটা ছিল তারই স্মারক। যাকে বলা হচ্ছে স্মার্ট প্রযুক্তি। বর্তমান সময়ে স্মার্ট মানেই ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকা। মুহূর্তেই সব তথ্য পাওয়া যায় যেখান থেকে। এই শতাব্দীতে আমরা প্রবেশ করেছি স্মার্ট যুগে। নেদারল্যান্ডসের গরুর খামারটিও ছিল স্মার্ট একটি গরুর খামার। গরুর খাদ্য দেওয়া থেকে শুরু করে দুধ সংগ্রহ পর্যন্ত—সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় যান্ত্রিক উপায়ে, স্মার্টলি। ডো মার্কের দুধ দোয়ানোর আধুনিক পদ্ধতিটাও বেশ চমকপ্রদ। সেখানে গাভি উন্মুক্ত বিচরণ করতে করতে নিজেই যখন উপলব্ধি করে তার দুধ দেওয়ার সময় হয়েছে, তখন লাইন ধরে দুধ দোয়ানো কেন্দ্রে উপস্থিত হয়। শুধু গাভির উপলব্ধি দিয়ে যন্ত্র সন্তুষ্ট হয় না, যন্ত্র যখন তার হিসাব দিয়ে উপলব্ধি করবে যে দুধ দোয়ানোর জন্য গাভি প্রস্তুত, তখনই সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দুধ দোয়ানো শুরু করবে, অন্যথায় নয়।

২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার চুংনাম প্রভিন্সের থম্বক গ্রামের কিম নামের খামারির খামারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কিম দুই শতাধিক গরুর একটি খামার একাই পরিচালনা করছিলেন। অফিসকক্ষে বসে কম্পিউটারে সব নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। গরুর খাবার দেওয়া থেকে শুরু করে দুধ দোহানো, দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ সবই হচ্ছিল অটোমেটিক যন্ত্রের সাহায্যে। এ বছর এপ্রিলে নেদারল্যান্ডসের ফ্রেইডোপিল এলাকায় আরেকটি ডেইরি ফার্ম দেখার সুযোগ হয়েছিল। ১১০০ হেক্টর জমির ওপর বিশাল এক খামার। খামারে ২ হাজার ৬০০টি গাভি। একেকটি গাভি বছরে দুধ দেয় ১১ হাজার লিটার। অথচ সম্পূর্ণ খামারটিতে মাত্র দুজন লোক। গাভির গোসল, খাবার দেওয়া, দুধ দোহানো সবই করছে যন্ত্র। উৎপাদিত দুধ চিলিং হয়ে অটোমেটিক প্যাকেটজাত হয়ে যাচ্ছে। দেখে বিস্মিত হতে হয়!

আমাদের দেশেও স্মার্ট গরুর খামার গড়ে উঠতে শুরু করেছে। নারায়ণগঞ্জের কাঞ্চনে ব্যবসায়ী এম এ সবুর তাঁর গরুর খামারটি নিয়ে এসেছিলেন গ্রামীণফোনের স্মার্ট গরুর খামার ব্যবস্থাপনায়। স্মার্ট ফার্ম ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি গরুর জন্য একটি করে চিপ থাকে। চিপটি সাধারণত গলার কলারে বা কানে ট্যাগে যুক্ত থাকে, যা গরুর শারীরিক ও পারিপার্শ্বিক সব ধরনের তথ্যই সংগ্রহ করতে সক্ষম। যেমন গরুর দেহের তাপমাত্রা, রক্ত সঞ্চালন, জাবরকাটা থেকে শুরু করে প্রজনন সময়ের নির্ভুল হিসাব দেয়।

মাতৃগরুর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য দিয়ে অসময়ের গর্ভপাত রোধ করতে সাহায্য করে। গরুর কী ধরনের পুষ্টির প্রয়োজন, কী পরিমাণ আলো-বাতাস লাগবে, এমনকি গাভির দুধ দেওয়ার সময় সম্পর্কেও নানা তথ্য খামারি ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত বেজ স্টেশন থেকে সরাসরি মোবাইল ফোনে চলে আসে। জানি না কী কারণে গ্রামীণফোনের ডিজি কাউ আর অগ্রসর হতে পারেনি। তবে আদর্শ প্রাণীসেবা লিমিটেডের ফিদা হক তাঁর বোলাস কার্যক্রম এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন।

কৃষি খামারে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, অর্থাৎ ইন্টারনেট অব থিংস ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার যে আমূল পরিবর্তন এনেছে, তা উন্নত বিশ্বের এসব খামার না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হতো। এতে উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, কমেছে উৎপাদন ব্যয়, বেড়েছে খাদ্যের মান।

টেকসই কৃষি অর্থনীতির প্রশ্নে সময় এখন বাণিজ্যিক কৃষি সম্প্রসারণের। উৎপাদনে বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে চাইলে প্রযুক্তির দিকেই ধাবিত হতে হবে। না হলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রতিনিয়ত। বাণিজ্যিক কৃষি মানেই প্রযুক্তির কৃষি। আর প্রযুক্তির কৃষি মানেই বড় বিনিয়োগের কৃষি। একজন ক্ষুদ্র কৃষকের পক্ষে বাণিজ্যিক কৃষিতে বিনিয়োগ সম্ভব নয়। ফলে শিল্প উদ্যোক্তাদেরই বাণিজ্যিক কৃষিতে অগ্রসর হতে হবে। আগেই বলেছি, আমাদের দেশে দুগ্ধ খাতে বাজার আছে। বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক করে সুপরিকল্পিত নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে এখনই আগামীর পথে হাঁটার সময়।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ