আমার ছেলে সামেরকে ছাড়াই আরেকটি ঈদ আমরা উদ্যাপন করে ফেললাম। কিন্তু বড় কষ্টের এই ঈদ। সাড়ে আট বছর আগে ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আমার জীবন তছনছ হয়ে যায়। ওই দিন আমার ছেলে সামের রেদা আবদেলফাত্তাহকে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আজও ফিরে আসেনি সে।
তিন সন্তানের বাবা সামের খুবই একজন হৃদয়বান মানুষ। তার চারপাশের সব মানুষ তাকে পছন্দ করত। যখন সামেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন তার বয়স ২৯ বছর। আর তার সবচেয়ে ছোট সন্তানের বয়স ছিল মাত্র পাঁচ মাস।
ওই দিন ফজরের নামাজের পর খুব ভোরে আমার ছেলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। সামের একজন বাসচালক ছিল এবং সেদিন সে আতারিব থেকে আলেপ্পোর মামুন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাচ্ছিল। পথে সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী একটি চেকপয়েন্টে থামিয়ে তাকে আটক করে নিয়ে যায়।
শেষবার যখন সামেরের সঙ্গে আমাদের কথা হয় সে তখনো চেকপয়েন্টে ছিল। বাড়ি ফেরার পথে আলেপ্পো থেকে কিছু সদাই আনার জন্য বেলা ১১টায় তার বাবা তাকে ফোন করেন। সামের তখন এমনভাবে কথা বলল যেন কিছুই ঘটেনি তার সঙ্গে।
কয়েক মিনিট পরে, আমরা চেকপয়েন্টের একজন ব্যক্তির কাছ থেকে একটি কল পাই। তিনি আমাদের জানান, সামেরকে আটক করা হয়েছে। আমার অন্য ছেলে তখন চেকপয়েন্টে ছুটে গেল এবং সামেরের মুক্তির জন্য অনেক অনুনয়-বিনয় করল কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তারা তাকে ফিরে যেতে বলে। ভাইকে বিপদের মুখে ফেলে ফিরে আসাটা যে তার জন্য কতখানি হৃদয়বিদারক ছিল, তা আমি অনুভব করতে পারি।
যেই মুহূর্তে আমি খবর শুনলাম যে আমার ছেলেকে আটক করা হয়েছে, আমার হৃদয় ভেঙে গেল এবং আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করলাম। এর পর থেকে আমি নামাজ পড়া বন্ধ করিনি। আমরা সামেরের মুক্তির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি, কিন্তু সামরিক কর্মকর্তারা বারবার আমাদের বলেন যে তাঁরা জানেন না কেন সামেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
সামের নিখোঁজ রয়েছে সাড়ে আট বছর ধরে। যদিও আমরা নিশ্চিত হতে পারি না যে সে বেঁচে আছে কি না, কিন্তু আমার হৃদয় আমাকে বলে যে সে বেঁচে আছে।
রমজান মাসটা আমাদের পরিবারের জন্য একটি বিশেষ কঠিন সময়। কেননা, এই মাসটা সামেরের নানা মধুর স্মৃতিতে ভরা। আমরা সব সময় একসঙ্গে ইফতার করতাম। নানা রকম কৌতুক বলে সামের ইফতারের টেবিল মাতিয়ে রাখত। সামের আমাকে প্রায়ই ডানাওয়ালা প্রাণীর খাবার বানাতে বলত। আমি বুঝতে পারতাম সে কী খেতে চাইছে। আমি তখন মুরগি গ্রিল করে দিতাম। এ নিয়ে অনেক মজা হতো।
সামের কুনাফে খেতে খুব পছন্দ করত। তবে আমি যখন অন্যান্য নাশতা বানাতাম, সেগুলোর প্রশংসাও সে করত। সে আমার খুবই ভদ্র এবং দয়ালু একটি ছেলে। এখন ইফতারের টেবিলে তার অনুপস্থিতি আমাদের চারপাশকে শূন্য করে দেয়। আমি এখনো তার প্রিয় খাবারগুলো তৈরি করে তার ভাগেরটুকু টেবিলের এক পাশে সাজিয়ে রাখি। এরপর যাদের প্রয়োজন রয়েছে, তা তাদের দান করি।
চার মাস আগে দারা শহরের এক ব্যক্তির কাছ থেকে একটি খবর পাই, যিনি কিনা কয়েক দিন আগে কুখ্যাত সেডনেয়া কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি আমাদের জানান, সামেরকে সেখানে মাটির নিচের এক কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে। সেখানে সামের ওই ব্যক্তিকে তার স্ত্রী ও বড় দুই সন্তানের নাম বলতে পারলেও ছোট সন্তানের নাম ভুলে গিয়েছিল। আমি অবাক হয়ে ভাবি আসাদ সরকারের অন্ধকূপে ওই রাক্ষসরা আমার ছেলের সঙ্গে কী এমন করেছে যাতে কিনা সে তার নিজের ছেলের নাম ভুলে যায়!
তবে এই খবর শুনে আমার মনে এই আশা জেগেছে যে সামের হয়তো বেঁচে আছে। হাজার হাজার মায়ের মতো, যাদের সন্তানদের গুম করা হয়েছে বা আটক করা হয়েছে, আমি আমার সন্তানের মুক্তির অপেক্ষায় আছি। আড়াই বছর আগে আমি ফ্যামিলিজ ফর ফ্রিডম আন্দোলনে যোগ দিই। নারী-নেতৃত্বাধীন এই আন্দোলন সিরিয়ার নিখোঁজ ব্যক্তিদের মুক্তির জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
সিরিয়ায় ১০ লাখের বেশি মানুষ আটক বা নিখোঁজ রয়েছে। আমি জানি যে আমি একা নই। আমাদের এই আন্দোলনের লক্ষ্য হচ্ছে আমাদের সেই প্রিয়জনদের, যারা আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং তাদের জানানো যে আমরা তাদের মুক্তির জন্য ক্লান্তিহীনভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি।
আমরা আমাদের প্রিয়জনদের জানাতে চাই যে তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা আমাদের সাধ্যের সবটুকুই করছি এবং আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, সিরিয়ার সরকারকে বন্দীদের মুক্তি দিতে চাপ দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের সমর্থন করতে। আমরা আরেকটি জিনিসের জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি তা হলো, একটি স্বাধীন এবং আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা, যা আমাদের মতো পরিবারগুলোকে তাদের প্রিয়জনদের অবস্থান খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।
আমার ছেলেকে আবার মুক্ত দেখব—মাঝে মাঝে তা দূরের স্বপ্নের মতো মনে হয়, কিন্তু কারও কারও মুক্তির খবর আমার মনে এই আশার সঞ্চার করে যে একদিন আমি একটি কল পাব বা দরজায় টোকা পাব এবং সেই কল কিংবা টোকা আমার ছেলে দেবে।
আমার প্রতিদিনের ইচ্ছা সে ফিরে আসুক, আমি যাতে তাকে দেখতে এবং তার সঙ্গে কথা বলতে পারি।
আমার প্রিয় সন্তান সামের, তুমি তোমার সন্তানদের নিয়ে গর্ব করবে; তারা তোমার মতো ভালো মানুষ হয়ে উঠছে। তোমার স্মৃতি সব সময় আমার সঙ্গে আছে। আমি তোমার নামে জাকাত দিচ্ছি, এই আশায় যে আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করবেন এবং নিরাপদে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনবেন। আমি তোমার জন্য লড়াই চালিয়ে যাব। যত দিন না তুমি এবং সিরিয়ার সব বন্দী মুক্ত হও, তত দিন পর্যন্ত আমি লড়াই বন্ধ করব না।
(আল জাজিরায় প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক ও কলাম লেখক রোকেয়া রহমান)