ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। পালা করে আসে মানুষের দরজায়। কড়া নাড়ে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে। হাজির হয় জীবন-জীবিকার, আনন্দ-বেদনার বার্তা নিয়ে। আর এর মধ্যেই আমাদের জীবনপ্রবাহ। এক অর্থে এই জলবায়ুজীবনই আমাদের নিয়তি। ঋতুর মেরুকরণের মধ্যেই প্রকৃতি যেন আপনা-আপনি গেয়ে ওঠে সুখ-দুঃখের গান। আর তারই সুরে সুর মিলিয়ে মানুষ সেই সব ঋতুকে উদ্যাপন করে থাকে।
বসন্তের আগে শীত যেন সন্ন্যাস প্রবৃত্তি নিয়ে হাজির হয়। হিমালয়ের পাদদেশের সন্ন্যাসীদের শ্বাস-প্রশ্বাস যেন এসে লাগে আমাদের শরীরে। যখন তার পালা শেষ হয়, তখন জরা-জীর্ণতার জাল যেন ছিঁড়ে ফেলতে চায় প্রকৃতি নিজেই। এটাই প্রকৃতির ধর্ম। তাই তো উত্তরের বাতাসের বিপরীতে বইতে থাকে মলয় বাতাস। আমাদের সামনে হাজির হয় বসন্ত। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে প্রকৃতি। কবির ভাষায় যদি বলি, ‘জরাজীর্ণতা কুহেলিকা ভেদী আসিয়াছে ঋতুরাজ/তার আগমনে বন-উপবন ধরিয়াছে নবসাজ।’ বন-উপবনের এই নতুন সাজের ভেতর দিয়ে মানুষের মনের মধ্যেও ফুটে ওঠে অগণন ফুল। কেননা, মানুষ তো প্রকৃতিরই সন্তান। তারপর আমরা উদ্যাপন করি বসন্ত ঋতুকে। প্রকৃতি এবং মনে যেন শত রঙের হোলি খেলা শুরু হয়।
তবে হঠাৎ করেই এই ঋতু উদ্যাপন শুরু হয়নি। এর রয়েছে দীর্ঘ সিলসিলা। যে-পথ বেয়ে এটি একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হলো, তা একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে। ফাল্গুনে নানা উৎসবের দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে। বলা হয়, পুরীতে ফাল্গুন মাসে যে-দোলোৎসব হতো, তার অনুকরণে বাংলাতেও প্রবর্তিত হয় বসন্ত উৎসবের রেওয়াজ। বাংলায় এই বসন্তকালেই রাসমেলা বা রাসযাত্রার প্রচলন হয় মধ্যযুগে। বসন্তকালে বাংলাদেশের খুলনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে রাসমেলার প্রভাবশালী প্রচলন আছে। এ ছাড়া প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা ফাল্গুনি পূর্ণিমা উদ্যাপনের মাধ্যমে বসন্তকে বরণ করে নিত। পরবর্তী সময়ে সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জি হিসাবে যে সন চালু করেন, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এরই সঙ্গে প্রচলন করেন চৌদ্দটি উৎসব পালনের রীতিও। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বসন্ত উৎসব। এরই ধারাবাহিকতায় আধুনিক যুগে যিনি বসন্ত উৎসবকে বাংলায় সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং জুতসই অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শান্তিনিকেতনে বিশেষ নাচ-গানের মাধ্যমে বসন্তবরণের রেওয়াজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চালু করেন। এ বিষয়ে তাঁর এন্তার লেখালেখি রয়েছে। তিনি বসন্তকে নানা সম্ভাবনার মাধ্যমে উপভোগ এবং উদ্যাপন করতে চেয়েছেন। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান আমলে বাঙালি সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারে এই বসন্ত উৎসব ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা পালন করছি এই উৎসব।
তাহলে এই বসন্ত উৎসব পালনের সঙ্গে মানুষের এবং প্রকৃতির সম্পর্কটা কোথায়? এটি কি শুধু উদ্যাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, নাকি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের গভীর কোনো বস্তুগত বা অবস্তুগত সংযোগ আছে? প্রকৃতিতে পুরোনো পাতা ঝরে গিয়ে যে নতুন পর্ণমোচী দেখা দেয়, যে ফুল দেখা দেয়, তা সত্যিই এক নতুন সম্ভাবনার খবর নিয়ে আসে। নিজেকে নতুন করে সাজানোর, নির্মাণ করার খবর নিয়ে হাজির হয়। আমরা জানি, জন্মের ধর্মই হলো সঙ্গম। সেই সঙ্গম, প্রকৃতির সম্ভাবনার মধ্যে মানুষের চিন্তাকে নতুনভাবে সুশোভিত, সুসজ্জিত করে দেখার সঙ্গম। এর মাধ্যমে এক নতুন মানুষের জন্মের আহ্বান নিয়ে হাজির হয় বসন্ত। বসন্তকে এই তরিকায় উদ্যাপন করারও বড় সুযোগ রয়েছে।
আমরা কবি-সাহিত্যিকদের সেই সব উদ্ধৃতি আওড়াই বসন্ত উৎসবে। কিন্তু কথা হলো, এ উৎসব পালনে ভেতরগত শিক্ষা কোথায়? প্রকৃতিগত শিক্ষার বাইরে যে এর ক্রমবিকাশের ভেতর এক শিক্ষা আছে, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। কারণ, এ উৎসব হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলমান সম্প্রদায়ের হাত ধরাধরি করে একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসবে পরিণত হয়েছে। কারণ, এ উৎসবটি আমরা একপ্রকার প্রায় জাতীয়ভাবেই পালন করে থাকি; অর্থাৎ সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, এ উৎসবের বিকাশ এবং প্রকাশের ভেতর আছে অসাম্প্রদায়িকতার রস; যা ছড়িয়ে যাওয়ার কথা ছিল আমাদের মনোজগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কিন্তু হোঁচট খাই তখনই, যখন দেখি আমরা এ উৎসবকে কেবলই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলি। আটকে ফেলি কোনো শিশির মধ্যে। তাকে কেউ যেন ছুড়ে মারে কোনো গভীর সমুদ্রের মধ্যে। মনে হয় যা আর তুলে আনা সম্ভব নয়। কারণ, যখন সাম্প্রদায়িকতা এই বাঙালির মধ্য থেকেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন আমরা ব্যথায় কাতর হয়ে পড়ি।
তাহলে কি প্রশ্ন তোলা যায় না যে ব্যতিক্রম ছাড়া বাঙালির মননের ভেতর এই বসন্ত উৎসব কোনো রেখাপাত করতে পারেনি। এই বসন্ত উৎসব কি কোনো শিক্ষা নিয়েই হাজির হলো না? নাকি বাঙালি তার সংস্কৃতির গভীর বোধ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। অনেকে হয়তো বলবেন, আমরা তো নিয়ম করে বসন্ত উৎসব একত্রে পালন করে থাকি। হ্যাঁ, এর অবশ্যই একটা ফল আছে। এটা অনস্বীকার্য। কিন্তু এটাও মনে রাখা জরুরি যে একত্র হওয়া আর এক হওয়া ভিন্ন জিনিস। আমরা যদি এই বসন্ত উৎসবের মাধ্যমে একত্র হয়ে এক না হতে পারি, তাহলে এ উৎসব পালন করা আর মরুভূমিতে বালুর চাষ যেন একই কথা হবে। কিন্তু আমরা হতাশ হতে চাই না—এই বসন্তের জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে শুভবুদ্ধি জেগে উঠুক। অসাম্প্রদায়িকতার বীজ এখানেই বপিত হোক।