হোম > ছাপা সংস্করণ

লাইফ সাপোর্ট আদতে কী সাপোর্ট দেয়

স্বপ্না রেজা

ঢাকার একটি অভিজাত হাসপাতাল। স্ট্রোক আইসিইউর সামনের জায়গাটুকুও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। লম্বা টানা ঘর। দুই ভাই একে অন্যকে জড়িয়ে কাঁদছেন আর ‘বাবা বাবা’ বলে ডাকছেন। বুক চিরে তাঁদের আর্তনাদ গোটা পরিবেশকে ভারী করে তোলে। হঠাৎ হঠাৎ তাঁরা উত্তেজিত হয়ে স্ট্রোক আইসিইউর দরজায় আঘাত করেন। ভেতরে ঢুকতে মরিয়া হন। নিরাপত্তাকর্মীরা এসে তাঁদের বাধা দেন। বাবাহারা দুই সন্তানকে এরই মধ্যে চারজন নিরাপত্তাকর্মী ঘিরে ফেলেন। ছোট ভাই বেশি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, একটা হার্নিয়ার সাধারণ অপারেশনে বাবাকে লাইফ সাপোর্টে নিল কী করে! ডাক্তারের কাছে কৈফিয়ত চান। সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ টাকা ব্যয়ের হিসাব চাইতে শুরু করেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে কসাই বলতে দ্বিধা করেন না।

তাঁর অভিযোগ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিতে পারে কিন্তু রোগী বাঁচাতে পারে না। ছোট্ট একটা হার্নিয়ার অপারেশন থেকে কী করে একজন মানুষ লাইফ সাপোর্টে যায়? অসুস্থ ভদ্রলোক হেঁটে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বলে তাঁর সন্তানদের দাবি। অস্ত্রোপচারও সফল হয়েছিল বলে বলা হয়েছিল। কিন্তু তার মাঝেই হঠাৎ শারীরিক দুর্বলতা ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আইসিইউতে শিফট হতে না হতেই লাইফ সাপোর্টে। দুই ভাইয়ের অভিযোগ, তাঁরা পরে জানতে পারেন তাঁদের বাবাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। হার্নিয়া অপারেশনের পর বাবার দ্রুত শারীরিক অবস্থার অবনতির কোনো সুস্পষ্ট কারণ চিকিৎসক বলতে পারেননি। শুধু হাজার হাজার টাকার ওষুধের তালিকা হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে আর লাইফ সাপোর্টের চার্জ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের বাবার প্রাণ শেষ পর্যন্ত রক্ষা পায়নি। বাবার মৃত্যু মেনে নিতে না পারার ঘটনা কিছুটা জটিল আকার ধারণ করে। বাইরে থেকে আত্মীয়স্বজন এসে জড়ো হয়। হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা করার আওয়াজ ওঠে।

কাছাকাছি থেকে অবলোকন করছিলাম এমন মর্মান্তিক ঘটনা। ছোট ভাই আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আমি বলে দিলাম আপনাদের রোগীও জীবিত অবস্থায় ফিরবে না। এরা লাইফ সাপোর্টে রোগী নিয়ে ব্যবসা করে। অপেক্ষা করুন! টের পাবেন!’

এক আত্মীয়ের চিকিৎসা বিষয়ে ১৩ দিন হাসপাতালে অন্য রকম অভিজ্ঞতা হলো। জীবন আর মরণের সন্ধিক্ষণের অবস্থা প্রত্যক্ষ করলাম খুব কাছ থেকে। আইসিইউ কিংবা লাইফ সাপোর্ট বিষয়ে এক অন্য রকম ধারণা হলো। আইসিইউর রোগীদের অ্যাটেনডেন্টদের অপেক্ষা করার একটি নির্ধারিত জায়গা রয়েছে হাসপাতালটিতে। দিনরাত গায়ে গায়ে লেগে থাকা রোগীর স্বজনেরা চাদর বিছিয়ে কখনো মাটিতে শুয়েছেন, কখনো বসেছেন। চেয়ার সীমিত। কেউ কেউ স্বজনের আসন্ন মৃত্যুর খবরে দল বেঁধে হাসপাতাল করিডরে গুমরে উঠছেন। শহর ও গ্রাম থেকে আসা মানুষগুলোর যে স্ট্যাটাসই হোক, সবাই এখানে এসে একই কাতারে দাঁড়িয়ে যান, যেতেই হয় যেন। ভেদাভেদ নেই, দূরত্ব নেই। ফিসফিস করে একজন আরেকজনের কাছে জানতে চান, ‘রোগীর লাইফ সাপোর্ট খোলা হয়েছে?’ ‘ডাক্তার কী বললেন তারপর?’ কিংবা ‘কত টাকা খরচ হলো এ পর্যন্ত?’ এমন অনেক প্রশ্ন। কেউবা আর্থিক সংকটের কারণে লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলতে চান বলে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন ডাক্তারের কাছে। শেষ সঞ্চয়টুকু ব্যয় করে কিংবা ধারদেনা করে আর কোনো অবলম্বন নেই জেনে পাগলপ্রায় স্বজনেরা। তবু যদি ফেরে প্রিয়জন।

আইসিইউ কিংবা লাইফ সাপোর্ট অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এ তথ্য বেশি প্রচার পায় কোভিডকালে। আইসিইউর সংকট এবং একটা শ্রেণির অসাধু চিকিৎসা-ব্যবসায়ীদের কারণে আইসিইউ সাধারণ মানুষের চিন্তার বাইরে চলে যায়। অভিযোগ ওঠে, রোগী বাঁচার সম্ভাবনা নেই জেনেও লাইফ সাপোর্টে রোগীকে নিয়ে পৌঁছান চিকিৎসক তথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং সেখানে ফেলে রাখেন শেষ চেষ্টার অজুহাতে। যদিও চিকিৎসক রোগীর স্বজনদের, অভিভাবকের সম্মতি নিয়ে ফেলেন আইসিইউতে প্রবেশের মুহূর্তেই। প্রিয়জনকে বাঁচানোর প্রবল ইচ্ছায় স্বজনেরা সব ধরনের চিকিৎসা গ্রহণপত্রে সম্মতি স্বাক্ষর দেন। তখন মাথায় থাকে না তাঁদের আর্থিক সংগতির কথা।

আমার আত্মীয়র ব্যাপারেও একই অবস্থা। আইসিইউর চিকিৎসক রোগীর অনেক ধরনের খারাপ পরিস্থিতির আভাস দিয়ে তাঁর চিকিৎসাসংক্রান্ত সব ধরনের চিকিৎসা বিষয়ে সম্মতি নিলেন। শুরু হলো চিকিৎসা। রক্তের শ্বেতকণিকা মারাত্মক রকম কমে যাওয়ায় তাঁর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার চরম অবনতি ঘটে। আইসিইউতে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা শুরু হয়। দুদিনের মাথায় রক্তের শ্বেতকণিকা বাড়তে শুরু করে। শরীরের আক্রান্ত অর্গানের উন্নতি হতে দেখা দেয়। একটা পর্যায়ে তাঁকে কেবিনে শিফট করা হয়। অবস্থার উন্নতি দেখে সবাই যখন স্বস্তি ফেলতে শুরু করে, ঠিক তার পাঁচ দিনের মাথায় তাঁর রক্তের শ্বেতকণিকা অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যাওয়ায় শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। দ্রুত আবার আইসিইউতে নেওয়া হয় এবং তার কিছুক্ষণের মধ্যেই লাইফ সাপোর্টে। চিকিৎসক ডেকে জানালেন, রোগীর অবস্থা ভালো না। পরিণতি খারাপের দিকে। হার্ট, ব্রেইন, লাং, কিডনি ঠিকভাবে কাজ করছে না। তাঁদের কাজ চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া। আর আমাদের এখন দুটো কাজ—এক. আল্লাহকে ডাকা, যদি মিরাকল কিছু হয় এবং দুই. টাকাপয়সা প্রস্তুত রাখা; বললেন চিকিৎসক।

ভাবছিলাম, পরম করুণাময় আল্লাহকে আমরা প্রতিনিয়তই স্মরণ করি। তাঁর কাছেই সব প্রার্থনা। কিন্তু টাকাপয়সা প্রস্তুত রাখার বিষয়টি অভিজ্ঞতার কোথাও নেই। কেমন প্রস্তুতি, কতটা প্রস্তুতি, কত দিনের প্রস্তুতি ইত্যাদি তো সব অজানা। বেশিক্ষণ লাগল না বুঝতে, যখন শুরু হলো আইসিইউ থেকে একটু পর পর ওষুধ ও অন্যান্য জিনিসের তালিকা দেওয়া। লাইফ সাপোর্টের চার্জের সঙ্গে ওষুধের এমন তালিকা প্রতিদিন ৭০ থেকে ৭৬ হাজার টাকা ব্যয়ের পথ বলে দিল। জোগাড় করে রাখতে হলো প্রতিদিনের জন্য ৫০-৭০ হাজার টাকা। এর মাঝে ক্ষণে ক্ষণে চিকিৎসকের ব্রিফিং, বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই। মিরাকল হলে কিছু হবে। তাহলে? প্রশ্নের উত্তর, ‘রোগীর ক্ষীণ শ্বাস তৈরি হচ্ছে। এটা ইতিবাচক কোনো ঘটনা না। তবু চিকিৎসক হিসেবে আমরা শেষ চেষ্টা করব।’

লাইফ সাপোর্ট নিয়ে রোগী বিছানায় থাকলেন আরও তিন দিন। জানলাম কেউ কেউ লাইফ সাপোর্টে আছেন এক মাস, পনেরো দিন, কেউবা সাত দিন। রোগীকে বাঁচাতে তাঁরা ঋণগ্রস্ত হয়েছেন, সম্পত্তি বিক্রি করছেন। লাইফ সাপোর্ট থেকে কেউ যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তা-ও নয়। তাঁরা ফিরেছেন, তবে জীবিত নয়, গেছেন জীবন পরিসমাপ্তিতে, আসল গন্তব্যে। যা-ই হোক, লাইফ সাপোর্টে থাকা অচেতন রোগীর শরীরে রক্ত দেওয়া হলো, আরও অনেক কিছু করা হলো। কিন্তু কোনো উন্নতি নেই। চিকিৎসকের একই কথা, বাঁচার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তবু চেষ্টা চলছে।

লাইফ সাপোর্টে থাকা একজন রোগীর স্বজন অসহায়ভাবে জানতে চাইলেন, অবস্থার উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে কি রোগীকে লাইফ সাপোর্টে থেকে কেবিনে নেওয়া যায় না? সেখানে চিকিৎসা চালানো যায় না? চিকিৎসক বললেন, ‘না। লাইফ সাপোর্ট থেকে সরালে রোগীকে সোজা বাসায় নিয়ে যেতে হবে, কেবিনে নয়। সেখানেই রোগীর মৃত্যু হতে পারে। আর যেটা হবে এতে রোগীর বাসায় কোনো ঘটনা ঘটলে আপনারা ডেথ সার্টিফিকেট পাবেন না।’ স্বজন যখন অসহায়ভাবে বললেন, ‘আর যে টাকা নেই আমাদের!’ এমন কথার কোনো জবাব দিতে পারেননি চিকিৎসক।

বাংলাদেশে চিকিৎসাব্যবস্থা সবার জন্য কী, এমন প্রশ্নের উত্তর সুবিধাপ্রাপ্তরা একভাবে দেবেন আর অসুবিধাপ্রাপ্তরা অন্যভাবে দেবেন। আমার দেখা অভিজ্ঞতা বলে চিকিৎসাব্যবস্থা সবার জন্য নয়। লাইফ সাপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছানো এবং তারপর রোগীর জীবনাবসান পর্যন্ত বিরাট খরচের যে ভার, তা নেওয়ার সক্ষমতা সব শ্রেণির মানুষের নেই। প্রচুর অর্থ ব্যয়ের পর কতজন রোগী শেষ অবধি বেঁচে ওঠেন—এমন প্রশ্নের জবাবে চিকিৎসক বলেন, ১০০ জনে ১ জন। আর প্রতিদিন এই আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে থাকছেন ১০ জনের মধ্যে ৫-৬ জন। আর যাঁরা আইসিইউতে শিফট হচ্ছেন তাঁদের অধিকাংশকেই লাইফ সাপোর্টে যেতে হচ্ছে। আমার আত্মীয়র মৃত্যু ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগেও ষোলো হাজার টাকার ওষুধ এবং রক্ত তাঁর শরীরের উপযোগী করে তোলার জন্য ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে লাইফ সাপোর্টের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ভুক্তভোগীদের অনেকের ধারণা, মৃত মানুষকে কেন্দ্র করে ব্যবসা করার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একটি বড় সুযোগ হলো ‘লাইফ সাপোর্ট’।

স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সরকারের আরও সুস্পষ্ট নীতিমালা ও কার্যকরী উদ্যোগ এবং সর্বোপরি কঠোর মনিটরিং থাকা দরকার। স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রতিটি মানুষের আয়ত্তে আনতে হবে। চাল, চিনি, তেল আর পেঁয়াজের ইচ্ছেমতো মূল্যবৃদ্ধির মতো লাইফ সাপোর্টের অবস্থা যেন না হয়। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক আদলে পরিচালিত হলে সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব থাকবে না।

স্বপ্না রেজা, কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ