হোম > ছাপা সংস্করণ

হাসির অন্তরালের কান্নাটা অজানাই

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আমাদের দুঃখের কাহিনি অন্তহীন। প্রশ্ন হলো, কারণ কী? আরও বড় প্রশ্ন, উদ্ধারের উপায় কী? দুঃখের কারণ ওই নন্দ ঘোষই, তা যতই সরল শোনাক না কেন কথাটা। নন্দ ঘোষের নাম পুঁজিবাদ। একসময় ছিল মানুষ যখন নিজেকে খুবই অসহায় ভাবত। দার্শনিক হবস অবস্থাটার বর্ণনা দিতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন যে মানুষ-জীবন তখন ছিল সলিটারি, পুওর, ন্যাস্টি, ব্রুটিশ ও শর্ট। সেই অবস্থা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য সামাজিক চুক্তির দরকার হয়েছিল, যে চুক্তির ভেতর থেকে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের উদ্ভব ঘটে। তারপর ইউরোপে রেনেসাঁ ঘটেছে। মানুষ ঈশ্বরকেন্দ্রিকতা ছেড়ে মনুষ্যকেন্দ্রিকতার জগতে চলে এসেছে, সৃষ্টি হয়েছে ইহজাগতিকতার ও ধর্মনিরপেক্ষতার। পথ পরিষ্কার হয়েছে পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য। পুঁজিবাদ বিকশিত হলো। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সৃষ্টিশীলতার জগৎটা অনেক বড় হয়ে গেল, উন্নত হলো জীবনযাত্রার মান। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিল বৈষম্য, পুঁজিবাদের, যা অনিবার্য উপাদান। ফলে যে নৈরাজ্য ও বর্বরতা থেকে রাষ্ট্র মানুষকে মুক্ত করবে বলে ভাবা হয়েছিল, তেমনটা ঘটল না। পুঁজিবাদ নিজেই দেখা দিল মস্ত বড় বিপদ হিসেবে।

বিপজ্জনক পুঁজিবাদ দীর্ঘকাল পৃথিবীকে শাসন করেছে, কিন্তু তার অবস্থা এখন শোচনীয়। নানা ধরনের ছাড় দেওয়া ও প্রচার-প্রতারণা সত্ত্বেও নিজের রক্তাক্ত হিংস্রতাকে সে আর আড়াল করতে পারছে না। পতনকালে পুঁজিবাদ সব মানবিক সম্পর্ককে ভেঙে ফেলতে চাইছে, ইতিমধ্যেই সবকিছুকে পরিণত করেছে পণ্যে। তার অর্জনগুলোর অনেক কিছুই আর মানুষের উপকারে লাগে না; বরং অধিকাংশ মানুষের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুনাফার লোভ কাজ করছে চালিকা শক্তি হিসেবে। দেখা দিয়েছে চরম ভোগবাদিতা ও বিচ্ছিন্নতা। আমাদের মাননীয় মন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে যে বলেছেন বেপরোয়া গাড়ি চালানো, সেই বেপরোয়া প্রতিযোগিতা ও আইন না-মানাটাও পুঁজিবাদের চরিত্রের ভেতরেই রয়েছে। পুঁজিবাদের অধীনে চলাচলের, যোগাযোগের ও উন্নতির সব পথই রক্তাক্ত, কম আর বেশি। 

পুঁজিবাদ খুব ঘটা করে সাজিয়ে-গুছিয়ে গণতন্ত্রের কথা বলে। প্রচার করে যে ভোটের ময়দানে সব মানুষ সমান এবং ক্ষমতাবান। কেননা পূর্ণবয়স্ক সব মানুষের ভোটাধিকার থাকে, ভোট দিয়ে তাঁরা সরকার বদলাতে পারেন। সর্বত্র না হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই সরকার বদলায়ও, কিন্তু তাতে শোষণ বদলায় না, অধিকসংখ্যক মানুষের ওপর অল্প কিছু মানুষের শাসনের অবসান ঘটে না। অন্যদিকে আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্বাচনের অর্থ দাঁড়ায় জোরজুলুম, প্রতারণা, ছিনতাই। যারা জেতে, তারা ওই শাসকশ্রেণিরই সদস্য, এদলের কিংবা ওদলের।

ভারতের জাতীয় নির্বাচনে উপর্যুপরি জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় নিকৃষ্টতম ধর্মীয় মৌলবাদীরা, ইতিহাসকে তারা ক্রমাগত পেছন দিক ঠেলছে এবং বহুজাতির দেশটিকে এক রাখতে চাইছে ধর্মের সাহায্যে এবং সেই প্রক্রিয়ায় মানুষকে মধ্যযুগের অন্ধকারে ফেরত নিয়ে যাওয়ার ব্রত ধারণ করেছে, পোশাকে ও মনে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে অবশ্য ধর্ম আসে না, তবে বর্ণ ঠিকই চলে আসে। সামনের নির্বাচনে আমেরিকাবাসীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে দুজন অযোগ্য প্রার্থীর মধ্যে কাকে তারা কম অযোগ্য মনে করে সে ব্যাপারে এবং সেই ব্যক্তিকেই পরিণত করতে হবে রাষ্ট্রের প্রধান কর্তায়, সর্বাধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে। লড়াই চলে এসেছে ডেমোক্র্যাটদের গাধার সঙ্গে রিপাবলিকানদের হাতির। প্রতীক দুটি উল্টো হলে হয়তো অনেকের চোখে সুখকর ঠেকত, ডেমোক্র্যাটদের গাধা হিসেবে দেখার অস্বস্তি থেকে বাঁচা যেত, কিন্তু তাহলে তো তাদের প্রতীক দাঁড়াত হাতি এবং সেই হাতি যে বানভাসি হাতি হবে, এ আশা বৃথা। নির্বাচিত হওয়ার পরেই উন্মত্ত হস্তীরূপে তার আত্মপ্রকাশ ঘটার কথা। হাতিকে হারিয়ে গাধা জিতবে, আবার গাধাকে হারিয়ে হাতি জিতবে। কিন্তু তাতে মানুষের ভাগ্যের যে ইতরবিশেষ ঘটবে, তা মোটেই নয়। এই সত্যটা অবিচল রইবে যে পুঁজিবাদের অধীনে গণতন্ত্র ওই রকমেরই হতে বাধ্য। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরও একটি সত্যের উন্মোচন ঘটছে। জানা যাচ্ছে, সবচেয়ে সুসভ্য বলে যে দেশ দাবি করে তার নেতৃত্বদানকারীরা ব্যক্তিগতভাবে কতটা নিম্নরুচির মানুষ হতে পারে সেই খবর।

পুঁজিবাদ মানুষকে খুবই ব্যস্ত রাখে, বিশেষ করে ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো নিয়ে। ছোট ছোট গণ্ডির ভেতর আটকে রাখাটাকে নিরাপদ জ্ঞান করে। বড় জায়গায় আসতে দিতে চায় না। একসময় আধুনিকতা ছিল ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার, এখন উত্তর-আধুনিকতা সাধনা করছে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতার।

আমাদের ছেলেবেলায়, শিশুদের জন্য পাঠ্য একটি বই ছিল, নাম ‘হাসিখুশি’, তাতে একটি ছড়া ছিল—কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যারে পারি তারে ছোঁ। পুঁজিবাদ মানুষকে ওই দশায় রাখতে আগ্রহী। মানুষ হাসিখুশি থাকুক, নিমগ্ন হোক স্থূল বিনোদনে, লিপ্ত থাকুক অর্থোপার্জনে, উত্তেজনা প্রকাশ করুক খেলার মাঠে, ছায়ার সঙ্গে কথোপকথন চালাক ঘরে বসে। লক্ষ্যটা হলো পুঁজিবাদের যে ব্যাধি পৃথিবীকে রুগ্‌ণ করছে, সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে টেনে নিয়ে গেছে, সে বিষয়ে মানুষ যেন সচেতন না থাকে। মানুষ চিন্তা করুক, চিন্তা তো তাকে করতেই হবে, কিন্তু সে চিন্তা হোক কানামাছি খেলার মতো। সবাই মিলে উত্ত্যক্ত করতে চায় চোখবাঁধা কানামাছিটিকে, সে বেচারা হাতড়ে হাতড়ে যাকে ছুঁতে পারবে তাকেই অপরাধী ভাববে। দোষ চাপানো চলবে পারস্পরিক। খেলাচ্ছে যে দুর্বৃত্ত আড়ালে থেকে সে হাসবে। এই দুর্বৃত্তটির আচার-আচরণ, স্বভাবচরিত্র এখন ক্রমাগত ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠছে। বৃত্তের ভেতর ঘুরতে থাকার ওই অগ্রগমন অব্যাহত থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না পুঁজিবাদবিরোধী বিশ্বব্যাপী লড়াইটা স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে সফল হচ্ছে। 

বাংলাদেশের মানুষ বিশেষভাবে হাসিখুশি অবস্থাতেই আছে। তাদের অধিকাংশ হাসিই অবশ্য দুঃখী মানুষের নিরুপায় হাসি। তবু দেখলে মনে হবে হাসছে, যেন আশায় আছে উন্নতি চুইয়ে চুইয়ে পড়বে। উন্নতির ভাগ সে-ও পাবে, যেন কর্তাদের উন্নতি তারই উন্নতি। দেশে গণমাধ্যম এখন দুইভাবে নিয়ন্ত্রিত—একদিকে সরকারের দ্বারা, অন্যদিকে সরকার-সমর্থক মালিকদের দ্বারা। ফলে হাসির অন্তরালের কান্নাটা অজানাই রয়ে যায়। এখানে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রও কাজ করছে না, ভবিষ্যতেও যে করবে, এমন আশা নিতান্তই ক্ষীণ। ওদিকে পুঁজিবাদী সম্পর্কগুলো হুলস্থুল করে খাড়াখাড়ি বেড়ে চলেছে। নানাভাবে তার পৃষ্ঠপোষকতা চলছে। গরিবের ভালোর জন্য ক্ষুদ্রঋণের যে আয়োজন গ্রামীণ ব্যাংক ও অন্যান্য এনজিও করছে, সেখানে উন্নয়ন যেটা ঘটছে, সেটা পুঁজিবাদী ঘরানারই; ক্ষুদ্রঋণের কারখানা থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজিবাদীরাই বের হয়ে আসছে, যতটা পারছে। এটা মোটেই তাৎপর্যহীন নয় যে পুরোনো দিনের সমবায়ী উদ্যোগ-আয়োজনগুলো যা ছিল, সেগুলো ইতিমধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, কারণ তারা অপুঁজিবাদী হওয়ার চেষ্টা করত। পুঁজিবাদ সর্বগ্রাসী এবং ভীষণ সন্ত্রাসী।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ