রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ নিয়ে অন্য অনেক দেশের মতো আমাদের দেশের মানুষও তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক পক্ষ এই হামলায় সরাসরি দোষী সাব্যস্ত করছে রাশিয়াকে। বলছে, রাশিয়ার এই ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের ওপর এই হামলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
অন্য এক পক্ষ এই মতের বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। তারা বলছে, দোনবাসে (ইউক্রেনের লুগান্স্ক ও দানিয়েৎস্ক অঞ্চল) ইউক্রেনীয় বাহিনী রুশভাষী নাগরিকদের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে দিনের পর দিন, তার একটা ফয়সালা হওয়া উচিত ছিল। এ কথার সমর্থনে তারা বলছে, পশ্চিমা বিশ্বই মূলত উসকে দিয়েছে রাশিয়াকে। ক্রমাগত নিষেধাজ্ঞা আর অপমানের ফলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ভালুকের মতো ঘুরে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া।
তৃতীয় পক্ষ এই পুরো ব্যাপারে সতর্ক হয়ে শুধু যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। আপাতত কারও পক্ষ নিচ্ছে না তারা। এই তৃতীয় পক্ষের মধ্যে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও রয়েছে।
দুই. আমরা যদি শুরুতে একটি প্রবাদবাক্যের আশ্রয় নিই, তাহলে ইউক্রেনে রুশ আক্রমণ বিষয়ে বর্তমান পরিস্থিতি বোঝা হয়তো কিছুটা হলেও সম্ভব হবে। ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’ প্রবাদটি এ ক্ষেত্রে সুপ্রযুক্ত বলে মনে হয়। গোটা বিশ্বে যারা জমিদারি করে বেড়াচ্ছে, বিশ্ববাসীর ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে, তাদের দাপটে ছোট ছোট দেশগুলোর অবস্থা যে ত্রাহি মধুসূদন, ইউক্রেন তারই সর্বশেষ উদাহরণ।
একটু পেছনে ফিরে তাকালেই আমরা এই সারিতে ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও সিরিয়াকে দেখতে পাব। পরাশক্তিরা ভেবেছে, এই দেশগুলোকে নিজেদের মতো ‘সভ্য’ বানাতে হবে, ব্যস, তা থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশগুলোয় হামলা করা হয়েছে।
যে দেশগুলোর কথা বলা হলো, সেই দেশগুলোয় সব সময় সুশাসন চলছিল— এমনটা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু বাইরে থেকে কোনো দেশকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচারের রায় মেনে নেওয়ার জন্য পরাশক্তিগুলো যা করেছে, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য ছিল না। এখন কে না জানে, সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠেকাতে গিয়ে কিংবা মুসলিম বিশ্বকে দ্বিধাবিভক্ত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সাদ্দাম হোসেন, লাদেনদের জন্ম দিয়েছে। স্বার্থ সিদ্ধি হয়ে গেলে তাদেরই শত্রু বানিয়ে নিশ্চিহ্ন করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নও হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া, আফগানিস্তানে যা করেছে, সেদিকেও আগ্রহী পাঠকের দৃষ্টি নিশ্চয়ই যাবে এবং সবখানেই পাঠক আবিষ্কার করতে পারবেন, পরাশক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে পৃথিবীকে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেওয়ার জন্য যা খুশি তা করে যাচ্ছে।
ফলে প্রবাদবাক্যটি বর্তমান বিশ্বের দর-কষাকষির প্রেক্ষাপটে যথার্থ।
তিন. এ কথা বলতে গিয়ে আরও বলতে হচ্ছে, বর্তমান বাজার অর্থনীতিতে ভূ-রাজনৈতিকভাবে কোন দেশ কখন কার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, সেটা বুঝে নেওয়ার পর তার ওপরই নির্ভর করবে বিশ্ব বাজারব্যবস্থা কোনদিকে এগোবে।
সবচেয়ে শঙ্কার ব্যাপার হলো, এই বাণিজ্যই এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালানোর আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চীন সফরে গিয়েছিলেন। এ কথা নিশ্চয়ই কাউকে মনে করিয়ে দিতে হবে না, গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সম্পর্ক কতটা নাজুক হয়ে পড়েছিল। অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের কতটা কাছে চলে গিয়েছিল চীন। বাণিজ্যের দর-কষাকষির ক্ষেত্রে এরপর যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মধ্যে সূক্ষ্ম বিরোধিতার সৃষ্টি হলো, যার ফলে এখন এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার দেশ দুটি কে কাকে ল্যাং মারতে পারে, তা নিয়েই নানা কলাকৌশল করে যাচ্ছে।
বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার।
চার. রাশিয়া আর চীন এ দুই দেশই বুঝতে পারছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ‘কোল্ডওয়ার’-এর সামনে পড়েছে। তাই মার্কিনদের জবাব দিতে যেকোনো ফ্রন্টে তাদেরও কিছু করতে হবে। সে ফ্রন্ট হোক ইউক্রেন, হোক তাইওয়ান।
কিন্তু কতটা নিবিড় হবে দেশ দুটির সম্পর্ক? পিকিংয়ের কাছ থেকে মস্কো কতটা আশা করতে পারে? কম করে হলেও রাশিয়া আশা করতে পারে, ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের ব্যাপারটি মন দিয়ে বুঝবে চীন। চীনের পররাষ্ট্র দপ্তর যেন এ ব্যাপারে সক্রিয় হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যেন রুশবিরোধী কোনো প্রস্তাব এলে তার বিপক্ষে দাঁড়ায়, চীনের পত্রপত্রিকা যেন রাশিয়ার পক্ষে লেখালেখি করে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে অর্থনৈতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আসছে, তা থেকে চীন নিজেদের সরিয়ে রাখতে পারে। এরপর আরও বড় পরিকল্পনা করতে পারে দেশ দুটি। তারা জাপান সাগরে দ্বিদেশীয় কৌশলগত সামরিক মহড়া করতে পারে, মার্কিন সপ্তম নৌবহরের জন্য হুমকির জন্ম দিতে পারে।
পিকিং মস্কোর কাছে কী চাইতে পারে? পিকিং মস্কোর কাছ থেকে চাইবে পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষেত্রে সংযম। অ্যাংলোস্যাকসনদের প্রতিনিধিরা এখন ‘কাগুজে বাঘ’ হয়ে গেছে বলে মনে করে চীন। এই বাঘ এখন ক্লান্ত। কিন্তু তারা এখনো ধনী। চীন পশ্চিমাদের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক খতিয়ে দেখবে, সেই সঙ্গে রুশদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করবে। ভুলে গেলে চলবে না, আমেরিকার সঙ্গে চীনের বাণিজ্য হয় ৬০০ ট্রিলিয়ন ডলারের, প্রায় একই অঙ্কের বাণিজ্য হয় পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গেও। আর রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য হয় ১৫০ ট্রিলিয়ন ডলারের। সুতরাং চীন বুঝে-শুনেই পা ফেলবে।
অন্যদিকে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস নিয়ে সংকটে পড়তে পারে ইতালি, জার্মানি আর ফ্রান্স। তারা কীভাবে এ সময় পদক্ষেপ নেবে, সেটাও দেখার বিষয়। তবে একটা কথা বলা দরকার, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে যেভাবে আশ্বস্ত করছিল, তাতে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার আক্রমণকে শুরুতে পাত্তা দিতে চাননি। কিন্তু ইউরোপ যে শুধু বক্তৃতা-বিবৃতিতে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে, সেটা বুঝতে পারেননি তিনি। সেই সুযোগটাই নিয়েছে রাশিয়া।
পাঁচ. রাশিয়া আর ইউক্রেনের সংকটটার দিকে একটু তাকানো যাক। ইউক্রেনের অভ্যন্তরস্থ লুগান্স্ক ও দানিয়েৎস্ক প্রজাতন্ত্রকে রাশিয়া স্বীকৃতি দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের দেশগুলো নতুন করে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল। আর তাতে সংকটটা আরও ঘনীভূত হলো। ইউক্রেন সংকট যে শুধু রাশিয়া আর ইউক্রেনের সংকট, তা তো নয়। এই সংকটের আরও কয়েকটি মুখ রয়েছে। যেমন রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সার্বভৌম অঞ্চল প্রশ্নে বিরোধ আছে; নিরাপত্তা নিয়ে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপের ভাবনার গরমিল আছে; ন্যাটোর সম্প্রসারণ নিয়ে ন্যাটোভুক্ত দেশ আর রাশিয়ার মধ্যে বিরোধ আছে। এগুলো এড়িয়ে ইউক্রেন সমস্যাকে বোঝা শক্ত।
শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ন্যাটোর উপযোগিতা আর ছিল না। তাই তাকে প্রসারিত করার চিন্তাও ছিল না। বড় বড় ইউরোপীয় দেশ আমেরিকাকে ছাড়াই নিজেদের নিরাপত্তা নিজেরাই রক্ষা করবে—এ রকম ভাবনাচিন্তা করছিল। অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল না হওয়ার চেষ্টা করছিল। বিশেষ করে জার্মানি তখন রাশিয়ার সঙ্গে নানা ধরনের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা ভাবছিল। কিন্তু যুগোস্লাভিয়ার সংকট সবকিছুই ওলোট-পালট করে দিল। ন্যাটোয় যোগ দিল চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি আর পোল্যান্ড। লাইনে থাকল জর্জিয়া আর ইউক্রেন। তখনই রাশিয়া সতর্ক হয়ে গেল। জর্জিয়া আর ইউক্রেন যেন ন্যাটোভুক্ত না হয়, সে জন্য তারা নানা ধরনের চাপ দিতে থাকল দেশ দুটির ওপর।
জর্জিয়ার চেয়ে ইউক্রেন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেন হলো ইউরোপের সিংহদ্বার। সেটা ছিল ইউরোপের শস্যভান্ডার। কিন্তু এখন সোভিয়েত-উত্তর প্রজাতন্ত্রগুলোর মধ্যে ইউক্রেনের অবস্থা জীর্ণশীর্ণ। রাজনৈতিকভাবেও দেশটি দুটো আলাদা শিবিরে বিভক্ত। এক দল তাকিয়ে আছে রাশিয়ার দিকে, আরেক দল ন্যাটোর মুখাপেক্ষী। আর তাদের মধ্যে থাকা সংঘাত দুর্বল করেছে ইউক্রেনকে।
ছয়. ইউরোপের পূর্ব দিকে ন্যাটোর সম্প্রসারণের চিন্তা ইউক্রেন সংকটকে ঘনীভূত করেছে। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের প্রসঙ্গ যদি আসে, তাহলে তা নিয়ে দ্বিমত করার কিছু নেই। কিন্তু জগতের সব বিষয় এতটা সরল নয়। বর্তমান বিশ্বে সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যও নজর রাখতে হয় পাশে কোন রাষ্ট্র আছে, কোন পথে এগোবে দেশ, দেশের অভ্যন্তরে মানুষের মনস্তত্ত্ব কী ধরনের। এসব কারণেই ইউক্রেন হয়ে উঠেছে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার বলি। দেশটির ভেতরেও জাতিসত্তাভিত্তিক সংকট অনেক গভীর। আরও একটি দুঃখজনক ব্যাপার রয়েছে। ইউক্রেন এতটা বড় দেশ নয় যে নিজেই নিজের সমস্যাগুলোর সমাধান করবে, আবার এতটা ছোট দেশও নয় যে অন্য দেশগুলো ইউক্রেনকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যাবে। ইউক্রেনের মতো দেশ যদি নির্দিষ্ট কোনো শক্তির কাছাকাছি হয়, তাহলে বিপরীত শক্তিও সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইউক্রেন সংকট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, এই সংকট শুধু একটি দেশের নয়। দেখিয়ে দিল, ইউক্রেনকে এখন কত ধরনের ধ্বংসের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
ইউক্রেনের সংকটটি শুধু কিয়েভের মাথাব্যথার কারণ নয়, পৃথিবীর মোড়লদের মাথাব্যথার কারণও। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ইউক্রেন তার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোর সমাধান করার অধিকার রাখে। তবে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার প্রশ্ন যদি আসে, তাহলে বলতে হয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ওয়ারশ জোটের পতন ও ন্যাটোর সম্প্রসারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছে। তাই ইউক্রেন সমস্যার সমাধান ইউক্রেনকে করতে দেওয়া হচ্ছে না। পৃথিবীর মোড়লেরাই তা নিয়ন্ত্রণ করছে। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো যুদ্ধবিরতি হবে, শান্তিচুক্তি হবে। কিন্তু এই উন্মাদনায় যেসব মানুষ বাস্তুচ্যুত হলো, যেসব মানুষ প্রাণ হারাল, তাদের দুঃখ দেখার কেউ থাকবে না।
এই হলো বাস্তব পরিস্থিতি।