ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে/ রাত দুপুরে অই/ ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে/ ট্রেনের বাড়ি কই?— কবি শামসুর রাহমানের কবিতার মতো ট্রেনের শব্দ আমাদের অনেকের কানে বাজে। ট্রেনের কথা বললেই বয়স্ক অনেকের মনে পড়ে যাবে ধোঁয়া ছেড়ে ট্রেন ছুটে যাওয়ার দৃশ্য।
তবে প্রকৌশলবিদ্যা ও শিল্পের বিকাশের ফলে ধোঁয়া ওঠা ট্রেনের ইঞ্জিন এখন আর নেই। কয়লা দিয়ে ট্রেন চালানোর সময় পেরিয়ে গেছে সেই কবেই। তাতে কি? এই ধোঁয়া ছেড়ে যাওয়া ইঞ্জিন দিয়েই তো ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছিল এই অঞ্চলে। ফলে এটি ইতিহাসেরই উপাদান। নতুন প্রজন্মের কাছে ট্রেনের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য এখনো সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের প্রথম কয়লাচালিত লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিন। নীলফামারীর সৈয়দপুরে দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানায় গেলেই দেখা যাবে এই ইঞ্জিন।
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার প্রদর্শনী ইয়ার্ডে সবুজ ঘাসের ওপর রাখা আছে তিনটি ইঞ্জিন। এর মধ্যে একটি কয়লাচালিত ন্যারোগেজ, একটি ব্রডগেজ এবং অন্যটি ডিজেলচালিত মিটারগেজ ইঞ্জিন। ইঞ্জিনগুলো দেখতে বিভিন্ন সময় সেখানে ভিড় করেন দর্শনার্থীরা। কারখানাটিতে একসময় স্টিম লোকোমোটিভ মেরামত করা হতো। সেই ইতিহাসের অংশ হিসেবে এই লোকোমোটিভ এখানে রাখা হয়েছে।
গত শনিবার সরেজমিনে ওই কারখানায় গিয়ে কথা হয় দর্শনার্থী আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামে। আমি স্ত্রী ও ছোট মেয়েকে নিয়ে এসেছি রেলওয়ে কারখানা পরিদর্শনের জন্য। লোকমুখে শুনেছি একসময় বাংলাদেশে কয়লার ইঞ্জিনচালিত ট্রেন চলত। আজ স্ত্রী-সন্তান সঙ্গে নিয়ে তা দেখলাম। মেয়েকে রেলওয়ের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি।’
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (ডিএস) সাদেকুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ১৮৬২ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের রেলসেবা চালুর পরবর্তী শত বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ইঞ্জিনগুলো বাংলাদেশের রেলওয়েতে সেবা দিয়ে এসেছে। ১৯৫৩ সালে কানাডার তৈরি ‘ইএমডি বি-১২’ মডেলের ২০০০ শ্রেণির মিটারগেজ লোকোর মাধ্যমে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ডিজেল লোকোর সূচনা হয় এবং রেলে ডিজেল ইঞ্জিনের চাহিদা ও ব্যবহার বাড়তে থাকে। তবে আধুনিকতার দাপটে ধীরে ধীরে কমতে থাকে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ব্যবহার। বাংলাদেশে সর্বশেষ স্টিম ইঞ্জিন পরিচালিত হয় ১৯৮৪ সালে।
রেলওয়ে কারখানা সূত্রে জানা গেছে, ১৮৭০ সালে সৈয়দপুরে ১১০ একর জমির ওপর নির্মিত হয় রেলওয়ে কারখানা। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই রেল কারখানার রয়েছে ২৬টি উপকারখানা। রেলের ছোট-বড় যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে ব্রডগেজ ও মিটারগেজ লাইনের বগি মেরামতের কাজ করা হয় এ কারখানায়। রেলওয়ে সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান অর্জনে দেশের বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ কারখানা পরিদর্শন করেন। রেল ইতিহাস জানার জন্য দর্শনার্থীর উদ্দেশে রাখা হয়েছে এই ইঞ্জিন তিনটি।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, তিনটি ইঞ্জিনই ইংল্যান্ডের ভলকান কোম্পানির তৈরি। কয়লাচালিত ন্যারোগেজ সিএস ১৫ বাষ্পীয় লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিনটি তৈরি করা হয় ১৯৩৬ সালে। কয়লাচালিত ব্রডগেজ বাষ্পীয় লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিন এসজিসি-জেড ২৪০ ১৯২১ সালে তৈরি হয়েছিল। আর ডিজেলচালিত এমএইচজেড-৮ (৩৩৩২) মিটারগেজ লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিন ১৯৮২ সালে।